কলকাতা: আরজি কর কাণ্ডের জেরে বেআব্রু রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থা। ক্ষোভে ফুঁসছে বাংলার চিকিৎসক মহল। কেঁচে খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়েছে কেউটে। স্বাস্থ্য দফতরের নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসছে। এরইমধ্যে চর্চায় ‘উত্তরবঙ্গ লবি’। সেই লবি কীভাবে স্বাস্থ্য ভবনের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে? এ নিয়ে মুখ খুলছেন একের পর এক চিকিৎসক। এবার মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ও জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্সের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও উঠে এল উত্তরবঙ্গ লবির কারসাজির অভিযোগ।
উঠছে গুরুতর প্রশ্ন
আইএমএ-র এক সদস্য তুলেছেন গুরুতর কিছু প্রশ্ন। বলছেন, ৯ অগস্ট মহিলা চিকিৎসকের হত্যার কয়েক ঘণ্টা পর কেন সেখানে উত্তরবঙ্গের প্রভাবশালী চিকিৎসক সুশান্ত রায়কে দেখা গিয়েছিল? আরজি করের চিকিৎসক না হওয়া সত্ত্বেও কার নির্দেশে তথাকথিত উত্তরবঙ্গ লবির কয়েকজন পৌঁছে যান সেখানে? তিলোত্তমার পরিবারের পাশে না থেকে কেন সেদিন রাত পর্যন্ত তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ঘরে বৈঠকে বসেন উত্তরবঙ্গ লবির চিকিৎসকেরা? প্রশ্ন আছে, উত্তর এখনও নেই। আইএমএ বেঙ্গলের চিকিৎসক নেতা সৌরভ দত্তের অভিযোগ, উত্তরবঙ্গ লবির একটা মাথা ডক্টর সুশান্ত রায় একটা আইএমএ-র গ্রুপে লিখেছিলেন প্রশাসনের নির্দেশে তিনি সেখানে গিয়েছেন। আরও কয়েকজনের নাম ছিল সেখানে। আমার প্রশ্ন ওনাকে কে যেতে বলেছিল? সত্যিই কী প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে এরকম কোনও নির্দেশ ছিল?
চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এখানে এমন কিছু চরিত্র উপস্থিত ছিলেন যাঁরা সরকারি কোনও পদে নেই, আরজি করের সঙ্গে যুক্তও নন। তাঁদের সঙ্গে স্বাস্থ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তা, কলকাতা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা এখানে উপস্থিত ছিলেন।”
এদিকে আইএমএ-র প্রেস বিবৃতিতেও উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্পষ্ট বলা হচ্ছে, আরজি কর কাণ্ডের পর আইএমএ-র ডাকা ভার্চুয়াল বৈঠকে উপস্থিত মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষরা ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ বিরুদ্ধে সরব হন। দক্ষিণবঙ্গের এক মহিলা অধ্যক্ষকে ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ এক চিকিৎসক বীরুপাক্ষ বিশ্বাস ফোনে হুমকি দেন বলে অভিযোগ। অভিযোগ, মোবাইল ল্যাপটপ নিয়ে পরীক্ষায় বসা, পরীক্ষায় গণ টোকাটুকি, নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া-সহ নানা অনিয়মের প্রতিবাদ করায় ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ কোপে পড়েন কেউ কেউ। পরীক্ষক পদ থেকে অপসারণ, অন্যত্র বদলি করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। ষড়যন্ত্রের মাথায় স্বাস্থ্য ভবন এবং স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু কর্তা জড়িত, যাঁরা উত্তরবঙ্গ লবির কথায় ওঠে-বসে বলে অভিযোগ। চিকিৎসক সৌরভ দত্ত বলছেন, “এ কথা তো সমস্ত প্রিন্সিপালরা বলছেন।” চিকিৎসক সংগঠনের নেতা মানস গুমটা তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, “সৌরভ দত্ত একটা সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি আইএমএ-র রাজ্য শাখার প্রতিনিধি। তিনি যখন একটা অভিযোগ করছেন তখন তাঁর বক্তব্যের সারবত্তা আছে বলেই মনে করি।”
প্রেস বিজজ্ঞপ্তিতে কয়েকজন চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করে তাঁদের ভূমিকা খতিয়ে দেখার আবেদন করা হয়েছে। ডাক্তার সন্দীপ ঘোষ, ডাক্তার সুহৃতা পালও ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ ঘনিষ্ঠ বলে অভিযোগ। ঘটনার দিন তদন্তকে ভুল পথে চালিত করা, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করার অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে উঠছে তাঁদের তদন্তের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে চিকিৎসক মহল। চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “সারাদিন এখানে থেকে যাঁরা তদন্তকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের যেন তদন্তের আওতার বাইরে রাখা না হয়।”
কী বলছেন সুশান্ত রায়?
অভিযোগ সম্পর্কে যুক্তি দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ লবির অন্যতম মুখ তথা ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলের সহ-সভাপতি সুশান্ত রায়। বলছেন, এর “এর পিছনে রাজনীতি রয়েছে। উত্তরবঙ্গ লবি নিয়ে এখন কথা হচ্ছে! কিন্তু, আগে তো কখনও আরজি কর লবি, এনআরএস লবি হতো না। তাহলে কেন উত্তরবঙ্গ?” তাঁর আরজি করে উপস্থিতি নিয়ে যুক্তি দিয়েছেন এই ডাক্তারবাবু। তাঁর দাবি, ১২টা ১০ মিনিটে ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলে একটি বৈঠক চলাকালীন তিনি খবরটা পান। আরজি করে পৌঁছন তার ঘণ্টাখানেক পরে। বাড়ির লোককে আত্মহত্যা বলা হলেও সুশান্তবাবুর দাবি, দুপুরের ফোনেই তিনি জেনে গিয়েছেন তিলোত্তমা ধর্ষণ ও খুন হয়েছেন। বলছেন, “সকাল সাড়ে ১০টার সময় ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে একটা ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প ছিল। এর মধ্যে একজন আমাকে ফোন করে জানায় ঘটনার কথা। বলা হয় একটা মেয়ে মারা গিয়েছে। রেপ হয়েছে। আমরা কয়েকজন সেখানে যাই।” অর্থাৎ সুশান্ত রায়ের কথাতেই স্পষ্ট তাঁরা ওই দিন সকালেই তিলোত্তমার খুন-ধর্ষণের কথা জেনে গিয়েছিলেন। এদিকে ১০টা ৫২ মিনিটের পরে তিলোত্তমার বাবা-মাকে ফোন করে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার জানান তাঁদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এ কথা বলা হল কেন? উত্তর এখনও অধরা। চিকিৎসক মহলের দাবি, তিলোত্তমার হত্যার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি তদন্তের আওতায় আনা হোক উত্তরবঙ্গ লবিকেও। চিকিৎসক মহলের প্রশ্ন, কার ছত্রছায়ায় এই উত্তরবঙ্গ লবির এত বাড়বাড়ন্ত?