
কলকাতা: ‘জীবন্ত লাশ হয়ে গিয়েছি।’ শীর্ষ আদালতের নির্দেশে চাকরি হারানোর পর একথাই বলছেন চাকরিহারারা। জীবন্ত লাশের তো ময়নাতদন্ত সম্ভব নয়। তবে কলমের খোঁচায় মৃত প্যানেলের পোস্টমর্টেম সম্ভব।
প্যানেলের মৃত্য়ুদিন ৩ এপ্রিল,২০২৫। এই ময়নাতদন্তের তৃতীয় পর্বের মূল বিষয়, এসএসসির হলফনামা।
কে অযোগ্য, কে যোগ্য? আদালতে খোলসা করে এসএসসি এ কথা জানালে চাকরি বাতিল হত না। এমনটাই বিশ্বাস যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকদের।এসএসসি কি আদৌ যোগ্য-অযোগ্য তালিকা দিয়েছিল? এক কথায় উত্তর- না, দেয়নি। তাহলে এতগুলোয় হলফনামায় এসএসসি কী দিল? কেনই বা এসএসসি চেয়ারম্যান ও শিক্ষামন্ত্রী বারবার করে বলছেন, তালিকা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোর্ট সন্তুষ্ট হয়নি!
এক নজরে এসএসসির হলফনামা:
১. এসএসসি হলফনামায় প্রথমেই স্বীকার করে নিয়েছিল যে ভুল হয়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যানেল ও র্যাঙ্ক জাম্পিংয়ের মাধ্যমে অনেকে অযোগ্য হয়েও চাকরি পেয়েছেন।
২. শুনানির শুরুর দিকে হাইকোর্টে সওয়াল জবাবে হলফনামা দিয়ে এসএসসি জানিয়েছিল, কারা অযোগ্য তা এসএসসি শনাক্ত করতে পারবে না। পরে অবশ্য তারা অবৈধদের বেশ কয়েকটি তালিকা প্রকাশ করে।
৩. পরবর্তীকালে এসএসসি হলফনামা দিয়ে ৪ ধরনের ‘ভুলের’ কথা স্বীকার করে। সংখ্যাতত্ত্বও দেয়। সেখানে তারা জানায়, নবম দশমে ১১ হাজার ৬১০ চাকরির সুপারিশের মধ্যে ৯৯৩ জন অবৈধ। একাদশ দ্বাদশে ৫৫৯৬ সুপারিশের মধ্যে ৮১০ জন অবৈধ। গ্রুপ সি শিক্ষাকর্মীদের ২০৩৭ সুপারিশের মধ্যে ৭৮৩ জন অবৈধ। ৩৮৮০ গ্রুপ ডি সুপারিশের মধ্যে ১৭৪১ জন অবৈধ।
৪. পরবর্তীতে ফের এসএসসি আরও অবৈধদের খুঁজে পায়। কোর্টে কমিশন লিখিতভাবে জানায়, মোট ১৪৯৮ জন প্যানেলে নাম না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ পেয়েছেন। ৯২৬ জন র্যাঙ্ক জাম্পিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। ৪,০৯১ জনের ওএমআরের নম্বরে গণ্ডগোল আছে। এর মধ্যে ২৩৯ জন এমন আছেন, যাঁদের নাম ২ ধরনের অবৈধের তালিকাতেই রয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মোট অবৈধের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২৭৬ জন।
৫. এরপর এসএসসি আদালতে ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর হলফনামা দিয়ে জানায়, সিবিআইয়ের তথ্য ও তাদের তালিকার মাধ্যমে যোগ্য অযোগ্য পৃথকীকরণ সম্ভব। তাই পুরো প্যানেল বাতিল নিস্প্রয়োজন।
যোগ্যদের খুঁজে পেল না SSC?
বারবার অবৈধদের তালিকা আদালতে জমা দিয়েছে এসএসসি। কিন্তু লিখিত হলফনামায় জোর গলায় কমিশন বলেনি বাকিরা যোগ্য।
তবুও প্রশ্ন, সিবিআই-এর খুঁজে দেওয়া ওএমআর শিটের ভিত্তিতে কেন যোগ্য-অযোগ্য পৃথকীকরণ হল না? এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতি নির্দেশনামার ৩১ পাতায় লিখছেন, “প্যানেল বাতিল না করার আর্জি আমরা মেনে নিতাম যদি এসএসসির কাছে ওএমআর শিটের হার্ডকপি বা মিরর ইমেজ থাকত।” অর্থাৎ এসএসসি জোর গলায় যোগ্যদের চিহ্নিত করেনি। তার ওপর এসএসসির কাছে ওএমআর শিটের বিন্দুমাত্র কিছু না থাকায় প্যানেলের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়েছে।
এখন অনেকেই বলতে পারেন, অযোগ্য চিহ্নিত হয়েই যখন গিয়েছিল, তাহলে বাকিরা যোগ্য। এখানেই আবেদনকারীদের আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “যোগ্য-অযোগ্যের প্রশ্নই আসছে না। প্রক্রিয়াটাই বেআইনি। তাই এসএসসি ও শিক্ষামন্ত্রীর এই বিভাজন গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।”
পৃথকীকরণ নিয়ে কী বলা হয়েছে অর্ডারে?
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, চাকরি বাতিলের নির্দেশ তখনই দেওয়া হয়, যখন যোগ্য ও অযোগ্য কর্মীদের পৃথক করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে একাধিক রায়ের কথাও উল্লেখ করেছে শীর্ষ আদালত।
পঞ্জাব সরকারের বিরুদ্ধে হওয়া একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, যোগ্য় ও অযোগ্য বাছাই করতে সর্বোতভাবে চেষ্টা করতে হবে। যদি পৃথকীকরণ সম্ভব হয়, তাহলে পুরো প্যানেল বাতিল করা অসঙ্গত। শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ, যোগ্য-অযোগ্য পৃথক করা সম্ভব না হলেই বোঝা যাবে, পুরো প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছে। শুধুমাত্র চাকরিপ্রার্থী যদি দুর্নীতিতে যুক্ত থাকে, সে ক্ষেত্রে যোগ্য-অযোগ্য খুঁজে বের করা সহজ বলেই মত সুপ্রিম কোর্টের।