কলকাতা : ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যুকে (Anis Khan Death) ঘিরে ক্রমেই বাড়ছে রাজনীতির চাপানউতোর। বার বার প্রশ্ন উঠে আসছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। সেদিন রাতে পুলিশের পোশাকে কারা এসেছিল? তার উত্তরও এখনও পর্যন্ত মেলেনি। এদিকে সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনার তদন্তে সিট গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশের গাফিলতির যে অভিযোগ উঠছিল, তা আরও কিছুটা স্পষ্ট করেছে মঙ্গলবার সকালের ঘটনা। সিট গঠনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমতা থানার তিন পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি যে ছিল, তা এই সাসপেন্ডের ঘটনা থেকেই স্পষ্ট। এখন দেখার ছাত্রনেতার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠে আসছে, তাতে আগামী দিনে কোনও দিকনির্দেশ পাওয়া যায় কি না।
আন্দোলনের ঝাঁঝ যত বাড়ছে, ততই দেড় দশক আগের এক ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। রিজওয়ানুর রহমান। মনে পড়ে? সালটা ছিল ২০০৭। সেপ্টেম্বর মাস। পুজোর ঠিক আগে। পাতিপুকুরে রেললাইনের ধার থেকে উদ্ধার হয়েছিল গ্রাফিক্স ডিজাইনার রিজওয়ানুর রহমানের দেহ। আনিস খানের মৃত্যুর পর যেভাবে ফুঁসছে মহানগর, রিজওয়ানের মৃত্যুতেও আজ থেকে পনেরো বছর আগে একইরকমভাবে কলকাতার রাজপথে ছিল কান্না আর ক্রোধ। আজ যেভাবে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, দেড় দশক আগেও একইরকমভাবে প্রশ্ন উঠেছিল পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। আর সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, আনিস খানের মৃত্যু তদন্তে সিটের নেতৃত্বে যিনি রয়েছেন, সেই জ্ঞানবন্ত সিংয়ের বিরুদ্ধেই অতীতে অভিযোগ উঠেছিল রিজওয়ানুর মামলায়। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে পরবর্তীতে কোনও তথ্য-প্রমাণ পায়নি। নবান্ন থেকে জানানো হয়েছিল, ভিজিল্যান্স সেল রিজওয়ানুর মামলায় জ্ঞানবন্ত সিংয়ের জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ পায়নি। দুই ঘটনার মধ্যে প্রায় ১৫ বছরের ব্যবধান থাকলেও, দুটির মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় এমন কিছু মিল রয়েছে, যা বারবার আনিসের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছে রিজওয়ানুরকে।
এ এক অসম প্রেমের গল্প। রিজওয়ানুর রহমান। গরিব মুসলিম ঘরের ছেলে। গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ে ঝোঁক ছিল। সেই সূত্রেই লাক্স কোজির মালিক অশোক টোডির মেয়ে প্রিয়ঙ্কা টোডির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। আলাপের পর বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। কিন্তু নিজেদের সম্পর্কের কথা পরিবারের থেকে গোপন রেখেছিলেন তাঁরা। ২০০৭ সালের অগস্টে বিশেষ বিবাহ আইনে পরিবারকে না জানিয়েই বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। বিয়ের কিছুদিন পরই প্রিয়ঙ্কাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন রিজ। কিন্তু মেয়ের রিজওয়ানুরের সঙ্গে বিয়ে মেনে নিতে পারেনি টোডি পরিবার। মেয়েকে বাড়ি ফেরানোর জন্য বারবার চাপ দিতে শুরু করে টোডি পরিবার। যেহেতু রিজওয়ানুর আর্থিকভাবে তেমন স্বচ্ছল ছিল না এবং তার উপর ভিন ধর্মের ছিল, সেই কারণেই মূলত বিয়ে মানতে চাননি তাঁরা। শেষে প্রভাব খাটিয়ে মেয়েকে ফিরিয়েও এনেছিলেন তাঁরা। সেই সময় প্রিয়ঙ্কাকে ফিরেয় আনার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছিলেন রিজ। কিন্ত হায়! তার আগেই সব শেষ। এক অসম প্রেমের লড়াইয়ে হার মানেন রিজওয়ানুর। ২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। কয়েকদিন বাদেই ছিল দু্র্গাপুজো। পাতিপুকুরে রেললাইনের ধারে পড়ে থাকতে দেখা যায় রিজওয়ানুরের লাশ। কীভাবে মৃত্যু হল রিজের? হিসেবে আত্মহত্যা হলেও তাতে প্ররোচনা ছিল। তদন্তে এমনটাই জানিয়েছে সিবিআই।
আনিস মৃত্যুর রহস্যে যেমন প্রশ্ন উঠছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে, পনেরো বছর আগে রিজওয়ানুরের মৃত্যুতেও একইভাবে প্রশ্ন উঠেছিল পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। বিশেষ করে প্রভাবশালী টোডি পরিবারের সঙ্গে লালবাজারের একাংশের সমঝোতার অভিযোগ উঠেছিল। রিজের পরিবার শুরু থেকেই অভিযোগ তুলে আসছিল, তাঁকে খুন করা হয়েছে। অথচ, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার আগেই পুলিশের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, খুন নয়, আত্মহত্যাই করেছেন রিজওয়ানুর। ঠিক যেমনটা এবার আনিসের মৃত্যুর সময় দেখা গিয়েছে – ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার আগেই মদ্যপ থাকার তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। যদিও পরবর্তীতে সিবিআই তদন্তে নেমে জানায়, ঘটনাটি আত্মহত্যা, তবে তাতে প্ররোচনা ছিল। অশোক টোডি, প্রদীপ টোডি, অনিল সারোগী, সৈয়দ মহিউদ্দিন, আইপিএস অজয় নন্দা এবং আরও দুই পুলিশকর্মী সুকান্তি চক্রবর্তী ও কৃষ্ণেন্দু দাসের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মামলা রুজু হয়।
পুলিশের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল রিজ মামলায়। প্রিয়ঙ্কাকে যখন বিয়ের পর রিজওয়ান নিজের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, সেই সময়ে টোডি পরিবারের থেকে বাঁচার জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন রিজওয়ানরা। নিরাপত্তার আবেদন জানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য প্রিয়ঙ্কা তাঁর বয়ানে জানিয়েছিলেন, তাঁকে পুরোপুরি খোলসা করে কিছু না জানিয়েই পুলিশ একাধিক কাজগে তাঁকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছিল। নিরাপত্তা দেওয়া তো দূরে থাক, উল্টে আরও বিপাকেই পড়তে হয়েছিল রিজওয়ানুরদের। জানা যায়, টোডি পরিবারের সঙ্গে একাধিক পদস্থ আধিকারিকের ভাল সম্পর্ক ছিল। সেই কারণে একাধিকবার পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছিল রিজদের। এমনকী প্রিয়ঙ্কাকে তাঁর বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে না দিলে সমস্যায় পড়তে পারে রিজ, এমন হুমকিও নাকি দেওয়া হয়েছিল। কথা না শুনলে অপহরণের মামলা করার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।
রিজওয়ানুরের মৃত্যু এবং তারপর ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠছিল, তা কার্যত বাম সরকারকে ভিত টলিয়ে দিয়েছিল। ইনসাফের দাবিতে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আসরে নামতে। বিক্ষোভের আঁচ সামাল দিতে রিজওয়ানুরের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। আশ্বাস দিয়েছিলেন ন্যায়বিচার হবে। কিন্তু তারপরও সরকারের উপর থেকে চাপ কমেনি।
২০০৭ সালে তখন রাজ্যের বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম শাসনকে তখত থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সেই মসনদে বসতে তখন বছর খানেক বাকি। রিজওয়ানের মৃত্যুতে সুর চড়ালেন মমতা। পথে নামলেন, রিজের মাকে সঙ্গে নিয়ে। ন্যায়বিচারের দাবিতে কলকাতার রাজপথে হাঁটেন মমতা। রিজের মৃত্যুতে ইনসাফের দাবি তোলেন। নাগরিক সমাজের তরফে এবং বিরোধী শিবিরের ক্রমাগত চাপের মুখে পড়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার প্রসুন মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানবন্ত সিং ও অজয় কুমার সহ পাঁচজন পুলিশ কর্তার ভূমিকা সন্দেহভাজন ছিল। এদিকে রিজওয়ান কাণ্ডের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন পরবর্তী সময়ে দেখা যায় ভোটব্যাঙ্কে। রিজওয়ান কাণ্ডের জেরে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কের একটি বড় অংশ বামেদের থেকে মুখ ফিরিয়ে মমতার দিকে ঘেঁষে গিয়েছিল বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রিজওয়ানুরের মৃত্যুর পর প্রায় পনেরো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এখনও পর্যন্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। ব্যাঙ্কশাল আদালতে রিজওয়ানুরের মৃত্যু মামলাটি চলছে বর্তমানে। সাক্ষ্যপ্রমাণ নেওয়ার কাজ চলছে সেসন কোর্টে।
আরও পড়ুন : ‘দিদিকে অনুরোধ, সন্ধ্যা ৬টার পর যেন কোনও পুলিশ-তদন্তকারী না আসেন…’, এখন কীসের ভয় আনিসের দাদার?