
কলকাতা: নেতাজি ইন্ডোরে চাকরিহারাদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপ্রিম কোর্টের কাছে রায়ের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাবে রাজ্য। চাকরিহারাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে তার আগে চাকরিহারাদের স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার বার্তা দিয়েছেন মমতা।
মমতা: আমরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাব। যদি ক্ল্যারিফিকেশন না মানে, তাহলে সবটা আগেপিছে ভরাট করে দেব।
মুখ্যমন্ত্রী: এবার সুপ্রিম কোর্টে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাবে রাজ্য। চাকরিহারাদের জন্য রাজ্যের হয়ে লড়বেন, অভিষেক মনু সিঙ্ভি, কপিল সিব্বল, রাকেশ দ্বিবেদী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত ভূষণরা।
মমতার কথায়, ” আমার কথা ট্যাপ করে প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠাবেন, আমাকে যাতে জেলে ভরা যায়। আমি ল জানি, আমিও আইনজীবী হিসাবে অনেকগুলো কেস করেছি। আমরা একটা ক্ল্যারিফিকেশন চাইব প্রথমে। যাঁরা এখন চাকরি করছেন, তাঁরা এখন কী করবেন? যাঁরা স্কুলে যেতেন, যাঁরা আজও স্কুলে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য কী ক্ল্যারিফিকেশন? স্কুলগুলো কারা চালাবে? এটা জানতে চাইব।”
মমতা: আমরা আবেদন করব, যারা যোগ্য, তাদের চাকরি না কেড়ে কাজ করার সুযোগ দেবেন না। যদি না দেয়, তাহলে মনে রাখবেন, তাদের চাকরি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। কোনও রাখঢাক না রেখেই বলছি, সুপ্রিম কোর্টের আইন মেনেই বলছি, যখন কেউ পথ দেখায়, পথের মধ্যেই পথ খুঁজে নিতে হয়। আমাদের প্ল্যান এ রেডি, বি রেডি, সি রেডি,… এই যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি কোনওভাবেই না যায়… আপনাদের তো কেউ টারমিনেট করেছে? আপনি আপানাদের কাজ করুন না, কে বারণ করেছে? ভলেন্টিয়ারি সার্ভিস কিন্তু চলতেই পারে। কীভাবে আটকাবে? সুপ্রিম কোর্ট মনে রাখবে, অলটারনেটিভ করব। চাকরি যাতে ফিরে পান, তার ব্যবস্থা প্রসেসের মধ্যে দিয়েই ২মাসের মধ্যে কমপ্লিট হবে। সার্ভিস ব্রেক হবে না। এক্সপেরিয়েন্স অ্যাডিশ্যনাল কনসেশন পাবেন, যাঁরা ১০ বছর ধরে চাকরি করছেন। এটা মাথায় রাখবেন।
আমি বেঁচে থাকাকালীন যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের কারোর চাকরি কেড়ে নিতে দেব না। এটা আমার প্রতিশ্রুতি। (নেতাজি ইন্ডোরে উঠ জয় মমতার জয় স্লোগান)।
এই রায়ের পিছনে কোনও খেলা তো নেই? সুপ্রিম কোর্ট বলেনি, কে যোগ্য কে অযোগ্য, সরকারকে যোগ্য অযোগ্য করে দেওয়ার সুযোগ দেয়নি। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংয়ের সুযোগও দেয়নি।
মামলা গেল ডিভিশন বেঞ্চে। সব বাতিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা দফতরকে বললাম, সব ভাল আইনজীবী দিয়ে মামলা লড়াতে।
নেতাজি ইন্ডোরের মধ্যেই শুরু হয় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। মেজাজ হারান মমতা। আমি গালাগালি খাব, আর আমার কথা আমি বলতে পারব না, তা কি হয়? যার ইচ্ছা থাকবে, যার ইচ্ছা চলে যাবে।
সিপিএম ৩৪ বছর অনেক অন্যায় করে গিয়েছে। কারণ আমি বলেছিলাম, বদল চাই, বদলা নই। তুমি গিয়ে কেন অ্যাপ্লাই করলে? বিকাশভট্টাচার্যকে প্রশ্ন মমতার। কেন সমস্ত তালিকা বাতিল করেছে? আজকে বাইরে আমার নামে বড় বড় কথা বলছো। আমি তো চাকরিগুলো দিয়েছিলাম। আমার সরকার দিয়েছিল। এক দুটো কাজ করতে গেলে ভুল হতেই পারে। সেই ভুল সংশোধনের জন্য প্রশাসনকে সময় দাও। তা তো দাওনি। রাইট টু মেক ব্লান্ডার্স! নেতাজি বলেছিলেন, ভুল করাও অধিকার। যদি কারোর ভুল হয়ে থাকে, সংশোধন করার দায়িত্ব কার? কোর্ট যদি প্রশাসনকে সেই দায়িত্ব দিত, প্রশাসন নিশ্চয়ই সেই কাজটা করতে পারত।
প্রথমে সিঙ্গল বেঞ্চে, প্রথমে অভিজিতবাবুর বেঞ্চে, একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির লিস্ট বাতিল করা হয়। তারপর ডিভিশন বেঞ্চে, সবটাই করা হয়। সিবিআইকে কেস দেওয়া হয়। সিবিআইকে সাহায্য করি, বলি বাছুন, কে যোগ্য, কে অযোগ্য। বলছে ছাব্বিশের ভোটের পর চাকরি করে দেব, আগে একটা কথা আমি আপনাদের বলি, তারপর আমি কী করতে পারি, সেটা আপনাদের বলব। কয়েক দিন ধরে আমাকে… যে মানুষটা জানে না কী হয়েছে, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি… আমি আমার জীবনে জেনেশুনে কারোর চাকরি খাইনি, অনেক বদহজম হওয়া সত্ত্বেও সিপিএমের একটা চাকরিও খাইনি।
মমতা: আমাদের সকলকে সঙ্কটের মধ্যে এসে দাঁড় করিয়েছে। ভাববেন না আমরা এটাকে ভাল করে মেনে নিতে পেরেছি। আসল কথা বলার আমাকে জেলেও ভরে দিতে পারে। আমি কেস স্টাডি করে দেখছিলাম। ভাইস চ্যান্সেলাররা রয়েছেন, আপনাদের সাপোর্ট দিতে এসেছেন। যাঁরা যোগ্য, বঞ্চিত হয়েছেন, দুটো ভাগে ভাগ করি। সুপ্রিম কোর্ট জানাতে পারেনি, কারা যোগ্য, কারা অযোগ্য। আইনে বলা রয়েছে, ১০ হাজার অপরাধী সাজা পেয়ে যাক, এক জন নিরপরাধও যেন সাজা না পান। ২০২২ সাল থেকে একটা নোংরা খেলা শুরু করেছিল। চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই। চাকরি কাড়ার যাঁদের ক্ষমতা রয়েছে, তাঁদের আমি ধিক্কার জানাই। কোনটা মুখ, কোনটা মুখোস, সেটা জানতে হবে।
চাকরিহারাদের আশ্বাস দিলেন সাহিত্যিক আবুল বাশার। তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের উপরেই ভরসা রাখতে হবে।
চাকরিহারা মেহবুব মণ্ডল: রিভিউ টু কিউরেটিভ, আমাদের জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। যতদিন না পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হচ্ছে, আমাদের কোনওরকম টারমিনেশন লেটার দেওয়া যাবে না। আমরা যে চাকরি করছি, তাতে স্বমহিমায় বহাল থাকতে চাই।
চাকরিহারা মেহবুব মণ্ডল
বক্তব্য রাখছেন বঞ্চিত শিক্ষক সংগঠনের কনভেনার সঙ্গীতা।
চাকরিহারা সঙ্গীতা: আমি কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের শিক্ষক ছিলাম। কিন্তু এখন আর নেই। কেন নেই? তার কারণ আদালতের নির্দেশ। প্রথমে হাইকোর্টের নির্দেশ, পরে সুপ্রিম কোর্টের। যোগ্য অযোগ্য বাছাই করা যায়নি। সিবিআই তদন্ত করছে, বাগ কমিটি তদন্ত করছে, তাও যোগ্য বাছাই করা গেল না। তারা কোনও তদন্ত করে উঠতে পারল না! সন্দেহের বশে ঠেলে ফেলে দিল।
চাকরিহারা সঙ্গীতা: আমার মতো হাজার হাজার সহযোদ্ধারা এখানে উপস্থিত, তাঁরা সামনের মাসে কী খাবে, জানে না। আমরা তো সুবিচার চেয়েছিলাম। যা যা তথ্য দেওয়ার দিয়েছিলাম, তারপরও এই অবস্থা। আমি আমার স্কুলের কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের একজন শিক্ষক ছিলাম। বাচ্চাগুলোর কী হবে।
চাকরিহারা সঙ্গীতা: আমরা কেবল ২০ হাজার নই, চাকরিহারা প্রত্যেক একজনের পিছনে পাঁচ জন। আজ সকলে আঙুল তুলছে, কী করে কত টাকা দিয়ে চাকরিটা পেয়েছিলিস? আমার ফেসবুকের ওয়ালে এসে লিখছে, কী রে কত টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলিস? সমাজে মুখ দেখাব কীভাবে?
চাকরিহারা সঙ্গীতা: মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমরা ন্যায় বিচার চাইছে। কেঁদে ফেলেন সঙ্গীতা। বললেন, আমি আইটি ছেড়ে এসেছিলাম। কারণ আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। আমাদের দোষ কি এটাই, যে আমরা ২০১৬ সালের পরীক্ষার্থী? কী করে বলতে পারে অল আর ফ্রড? আমায় যোগ্যতায় পাওয়া চাকরিটা ফিরে পেতে চাই। আর কিছুই চাই না।
চাকরিহারা শিক্ষক
নির্ধারিত সময়ের আগেই নেতাজি ইন্ডোরে পৌঁছলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চাকরিহারাদের মধ্য়ে বিভাজন যখন ফাটলে পরিণত হয়েছে, সেই আবহে কার্যত বিবাদে ‘দাঁড়ি’ টেনে ইন্ডোরে এলেন মমতা।
টানা বিক্ষোভ। উত্তাল পরিস্থিতি। সাত সকালে ‘যোগ্য’ ও ‘অযোগ্য’ চাকরিহারাদের মধ্যে আড়াআড়ি বিভাজন। বচসা থেকে হাতাহাতি সব মিলিয়ে সরগরম পরিস্থিতি। নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। তার মধ্যে খানিক আগেই ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সামনে পৌঁছলেন পুলিশ কমিশনার মনোজ কুমার ভর্মা।
ভোর তিনটে থেকে তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সামনে। দুপুরে বৈঠক। তার আগেই পাস-বিতর্কে যোগ্য বনাম অযোগ্যের ‘লড়াই’। তার মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন বেশ কয়েকজন চাকরিহারা।
এক চাকরি খোয়ানো শিক্ষকের দাবি, ‘আমরা মরতেও রাজি আছি। চাকরি বহাল না রাখতে পারলে আমাদের মৃত্যুদণ্ড দিক। কারণ চাকরি না থাকলে কী করব আমরা? চাকরি না ফেরত দিতে পারলে আমরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতেও রাজি আছি।’
নেতাজি ইন্ডোরের মতো একই পরিস্থিতি বাবুঘাটে। চাকরি ফেরতের দাবি তোলার পাশাপাশি ‘চিহ্নিত অযোগ্যদের’ বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামল ‘যোগ্য’ চাকরিহারারা। মমতার বৈঠকের আগেই আড়াআড়ি ‘বিভাজন’ ২৬ হাজারের মধ্যে।
কে যোগ্য, কে অযোগ্য? মমতার বৈঠকে প্রবেশ নিয়ে সংঘাত চাকরিহারাদের মধ্যেই। সোমবার বৈঠকের আগেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সামনে জড়ো হলেন ‘চিহ্নিত অযোগ্যরা’। আর তাতেই ক্ষোভ চড়ল ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের মধ্যে, তৈরি হল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।