কলকাতা: বঙ্গ রাজনীতিতে তাঁরা পরিচিত ছিলেন ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’ নামে। তাঁরা অর্থাত্ সোমেন মিত্র, প্রিয় দাশমুন্সি ও কনিষ্ঠতম সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সেই অধ্যায় অবশেষে শেষ! অন্তিমের পথে যাত্রা করলেন সুব্রত। সোমেন ও প্রিয়রঞ্জন দাশমুুন্সি আগেই চলে গিয়েছেন। বাঙালি রাজনৈতিক ট্র্যাডিশনই চিরকাল বহন করে এসেছিলেন এই তিন নেতা।
নাম সুব্রত। সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ‘সুব্রত’ শব্দের অর্থই হল ‘সুষ্ঠুভাবে ব্রত পালন করেন যিনি’। আশ্চর্য! নিজের নামের দায়ভার যেন অজান্তেই চিরকাল বহন করে গিয়েছেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী। সারেঙ্গাবাদ থেকে কলকাতায় ইতিহাস নিয়ে পড়তে এসেছিলেন সুব্রত। ভর্তি হয়েছিলেন বঙ্গবাসী কলেজে। স্নাতকের পড়া শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। সেখানেই রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জনের হাত ধরে। ‘গুরু’ প্রিয়র হাত থেকে পেয়েছিলেন একজোড়া ধুতি ও পাঞ্জাবী। সেই শুরু। ৭৫ বছরের জীবনে তার পরিবর্তন হতে দেননি, রাজ্যের সদ্যপ্রয়াত পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় (Subrata Mukherjee)।
বঙ্গ রাজনীতির শীর্ষে তখন কংগ্রেস। একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে বাম শিবির। কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জনের দীক্ষায় ততদিনে পোক্ত হয়ে উঠেছেন যুবক সুব্রত। নেমে পড়লেন কংগ্রেসের পক্ষে প্রচার করতে। একদিন, প্রচার করার ফাঁকে সুব্রতকে ডেকে পাঠালেন প্রিয় দাশমুন্সি। ঢোলা প্যান্ট, হালকা শার্ট পরা সুব্রতর হাতে ধরিয়ে দিলেন একজোড়া সরু কালো পাড়ের ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবী। নিজের শিষ্যকে নির্দেশ দিলেন, “আজ থেকে ধুতি আর পাঞ্জাবী পরে প্রচার করবি। যা বেরিয়ে পড়…”
‘গুরুর’ সেই নির্দেশ শেষদিন পর্যন্তই পালন করে এসেছেন সুব্রত। সেই সরু কালোপেড়ে ধুতি অথবা সাদা ধবধবে ধুতি আর পাঞ্জাবীতেই বরাবর দেখা গিয়েছে সুব্রতকে। ‘৭১ সাল থেকেই ধুতি পরে প্রচার। সেখান থেকে বিধায়ক, তারপর একে দায়িত্ব ও পদ বৃদ্ধি। কংগ্রস ছেড়ে তৃণমূলে যখন গেলেন তখনও পোশাকের পরিবর্তন হয়নি। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে সর্বপ্রথম রাজ্য়ের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হওয়ার পরেও বহাল রেখেছিলেন বাঙালী ট্র্যাডিশন।
সাধারণত বিধানসভায় বাংলার মুখ্য়মন্ত্রী বলতে যে চিরাচরিত ‘ইমেজ’ ভেসে আসে তা বোধহয় ধুতি পরিহিত নেতা অথবা শাড়ি পরিহিতা মুখ্য়মন্ত্রী।কোনও বিশেষ ধরণ বা লিঙ্গভেদ অথবা কোনওরকম সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে নয়, বরং বাঙালির ‘আলুভাতে’ জীবনে জড়িয়ে থাকা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমাটাই এমন। সেই ‘এমনি’ ‘এমনি’ , ‘এমনটাই যেন’ ভঙ্গিমাটিকে শুধু গ্রহণ নয়, বহন করেছিলেন সুব্রত। একবিংশ শতকে বোধহয় একমাত্র তিনিই নিয়ম করেই ধুতি-পাঞ্জাবী পরতেন। পরের দিকে যদিও, অমিত মিত্র বা মদন মিত্রের মতো নেতৃত্ব শখে হোক বা অভিরুচিতেই ধুতি পরা শুরু করেছেন তবে অমন সদাস্নিগ্ধ, হাস্যময়, সহজ ভঙ্গিতে সদর্পে ধুতি পরার ‘ট্র্যাডিশন’ অবশেষে শেষ এমনটা বলা যেতেই পারে।
TV9-কে দেওয়া সাক্ষাত্কারেই সুব্রতবাবু নিজেই বলেছিলেন, “বিধানসভায় এখন অনেকে এমন জামাকাপড় পরে আসেন, যেগুলো বিধানসভায় পরে আসা যায় না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হয়।” একটু থেমে নিজের এক পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা ভাগও করে নেন তিনি। বলেন, “একজন মন্ত্রী এলেন ছেঁড়া জিনস পরে! আমি তাঁকে ডেকে নিয়ে যাই বিধানসভার বাইরে। আমার জুনিয়র। ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘দেখো এটাকে আমারা মন্দির বলে মনে করি। আর যে এটাকে মন্দির ভাবতে পারবে না, সে কন্ট্রিবিউট করতে পারবে না। সারা বাংলার সেবা কাজ চলে এই মন্দির থেকে। এখানে কেন এটা পরে এলে। আমি বলছি না আমার মতো ধুতি পরো। এটা আমার রুচি আমার কালচার। কিন্তু তুমি এটা পরো না।” বর্ষীয়ান নেতার ধমকে নাকি কাজ হয়েছিল। আর কোনও দিন ওই প্রাক্তন মন্ত্রী তথা ক্রিকেটার আর ভুলেও কখনও অমন পোশাক পরে আসেননি।
কেন এই পোশাকে ‘ট্র্যাডিশন’ বহন? শুধুমাত্র কি গুরু প্রিয় দাশমুন্সির নির্দেশে? সুব্রতবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, বরাবরই নিজের মূল শিকড়টিকে কখনও ফেলে আসেননি সুব্রত। এক আপাদমস্তক বাঙালি রাজনীতিক, পাড়ার ‘দাদা’, তৃণমূল নেত্রীর ‘সুব্রতদা’ ছিলেন যথার্থই সেই বাঙালির নিজস্ব ‘আলুভাতে’ জীবনধারকের জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। যিনি কখনও তাঁর ‘ব্রত’ থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁর মৃত্যুতেই যেন বিধানসভার শেষ ‘ঘরোয়া’ অনুভবটাও মুছে গেল। যেন কেউ সযত্নে মুছিয়ে দিল। এমনই তো হয়… নিঃসাড়ে, নিঃশব্দে মাঝেমধ্য়েই পাতাঝরার মতো যেন হারিয়ে যায় এমন টুকরো বেঁচে থাকা!
আরও পড়ুন: চপ-মুড়ি, চাউমিন, ‘শেষ পাতে’ চেয়েছিলেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী