কলকাতা: শিক্ষক নেই। অভাবে ধীরে ধীরে বন্ধের মুখে রাজ্যের একাধিক স্কুল (School)। ক্রমেই বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যা। গোটা রাজ্যে সরকারি স্কুলগুলির কী অবস্থা? জানতে চেয়ে রাজ্যের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট তলব করেছে হাইকোর্ট। কিন্তু, সেই রিপোর্ট সামনে আসার আগেই খোঁজখবর শুরু করল TV9 বাংলা। তাতে যা তথ্য় উঠে এল তাতে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! যদিও, বিকাশ ভবনের দাবি, সবকিছু ঠিক রয়েছে। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতে নাকি কোনও ফারাক নেই!
কোথাও পড়ুয়ার সংখ্যা সাড়ে সাতশো, শিক্ষক মোটে দুজন। কোথাও আবার শিক্ষকের সংখ্যা ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় ছ’গুণ বেশি। এ রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক-পড়ুয়ার অনুপাতে এতটাই ফারাক! কম-বেশি এক ছবি মাধ্যমিক স্তরেও। প্রশ্ন উঠছে কেন এই ফারাক? জেলাওয়াড়ি ছবিতে দেখা গিয়েছে, শিক্ষক-পড়ুয়ার যে অনুপাত সামনে এসেছে তা রীতিমতো অস্বাভাবিক। কীরকম সেই ছবি?
মালদা– ১:৯৪ (অর্থাত্, ১ জন শিক্ষক ৯৪ জন পড়ুয়াকে পড়ান)
মুর্শিদাবাদ – ১:৮১
বাঁকুড়া – ১:৫৩
জলপাইগুড়ি – ১:৯২
ঝাড়গ্রাম – ১:৮৮
নদিয়া– ১:৭৫
একই ছবি মাধ্য়মিক স্তরেও। সেখানেও শিক্ষক-পড়ুয়া অনুপাতের ফারাক চোখে পড়ার মতো।
মুর্শিদাবাদ – ১:৫৯
জলপাইগুড়ি – ১:৫৫
উত্তর দিনাজপুর – ১:৫৫
অর্থাত্, শিক্ষক প্রতি প্রায় ৫০ জন পড়ুয়া। এখানেই শেষ নয়, সমস্যার শিকড় উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও। এ বছর কোভিড আবহে মাধ্য়মিক ও উচ্চমাধ্যামিক পরীক্ষা হয়নি। ফলে, বিপুল সংখ্যক নম্বর যেমন ঝুলিতে এসেছে তেমন মাধ্য়মিকে পাশের হার দাঁড়িয়েছে ১০০ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ ছেলেমেয়েরা কোথায় কীভাবে ভর্তি হবেন তা নিয়ে রয়েছে ধন্দ। কেন?
এ বছর, সব মিলিয়ে মাধ্য়মিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ১২ লক্ষ। তার মধ্যে ৯ লক্ষ ৯৬ হাজার নিয়মিত পরীক্ষার্থী। পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে মাধ্য়মিক স্কুলের সংখ্য়া সাড়ে ১০ হাজার। মাদ্রাসা মিলিয়ে সেই সংখ্যাটা প্রায় ১২ হাজার। উচ্চ মাধ্য়মিক স্কুলের সংখ্যা সেখানে ৭ হাজার। এরমধ্যে প্রত্য়েক স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকে খাতায় কলমে অন্তত ভর্তি হতে ২৭৫ টি আসন রয়েছে। অর্থাত্, হিসেব করলে প্রায় সাড়ে ৩লক্ষ পড়ুয়া বাদ থাকবেন ভর্তি তালিকা থেকে। কারণ, স্থান সঙ্কুলান! দ্বিতীয়ত, সব স্কুলেই কি ভর্তির পরিকাঠামো এত গঠনশীল যে চাইলেই পড়ুয়ারা নিজেদের পছন্দমতো বিষয় নিয়ে একাদশে ভর্তি হতে পারবেন ? সেক্ষেত্রে পড়াশোনার মান কী হবে?
পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের ভ্রুকুটিভঙ্গী থেকে বাদ যায়নি খোদ শহর কলকাতাও। শহরের কয়েকটি স্কুলে সেই দুর্বল পরিকাঠামোটাই স্পষ্ট। কীররকম সেই ফারাক? কেন বন্ধের মুখে সরকারি স্কুল?
শহীদ স্মৃতি বিদ্যালয়: পড়ুয়া সংখ্যা ৮
শিল্প কলা শিক্ষা মন্দির: পড়ুয়া সংখ্যা ২৬
পাইকপাড়া কুমার আশুতোষ ইনস্টিটিউশন: পড়ুয়া সংখ্যা ১৪
অমর ভারতী হাইস্কুল: পড়ুয়া সংখ্যা ৩০
সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল: পড়ুয়া সংখ্যা ২৫
কেন এই ফারাক? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা ? সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের অনুমান, স্কুলছুটের প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে এই রাজ্যের স্কুলগুলির পড়তি অবস্থা সমানুপাতী। বিভিন্ন কারণে রাজ্যে স্কুলছুটের প্রবণতা বাড়ছে। প্রথমত, করোনা আবহে অনলাইন ক্লাসের পরিকাঠামো ও রসদের অভাব। সকলের পক্ষে এই অনলাইন ব্যবস্থায় যোগদান সম্ভব নয়। এছাড়া রয়েছে একাধিক আনুষাঙ্গিক কারণ। স্কুলগুলিতে শৌচাগার না থাকা, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের অভাব, পরিকাঠামোর অভাব, চু্ক্তি ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের ফলে সৃষ্ট বৈষম্য। কারণ নানাবিধ।
শিক্ষা মহলের মতে, জেনারেল ট্রান্সফার নিয়ে গ্রাম বাংলা থেকে শহরে চলে আসার জন্যই জেলার স্কুলগুলিতে শিক্ষকের অভাব। আর শহরে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছাত্র বেশি যাওয়ায়, বাংলা মাধ্যমে ছাত্রের অভাব। সব মিলিয়ে অসম বণ্টনের দরুন দেদার বিঘ্নিত হচ্ছে ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত। শিক্ষকের চাহিদা রয়েছে বহু স্কুলেই। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
মেমারি রসিকালি বিদ্যালয়। এখানে বিজ্ঞান, ইতিহাস ও রসায়ন বিভাগে শিক্ষক প্রয়োজন। ইটাচুনা শ্রী নারায়ণ ইনস্টিটিউশন। এখানে সোশ্যাল সায়েন্স, বিজ্ঞান ও অঙ্কের শিক্ষক দরকার। সোদপুর বালিকা বিদ্যালয় – ভূগোল, অঙ্ক, জীবন বিজ্ঞান, রসায়ন, শরীর শিক্ষার শিক্ষক প্রয়োজন। সাতগ্রাম কুর্শামারি হাই স্কুল। এখানে বাংলার ৩ জন শিক্ষক, অঙ্ক, সংস্কৃত, ভূগোল সহ অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষকের দরকার।
গ্রামের মতো শহরতলির ছবিও প্রায় একই। সোনারপুরের আচার্য প্রফুল্ল নগর আতুলকৃষ্ণ বিদ্যায়তনের ছাত্রী সংখ্যা ২,০০০। হিসাব মতো শিক্ষক প্রয়োজন ৫০ জন। অনুমোদিত পোস্ট রয়েছে ৩৭। আর এখন শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ২৮ জন। এই স্কুলগুলিতে পার্শ্ব শিক্ষক দিয়ে কোনওক্রমে ঠেকেঠুকে চলছে পড়াশোনা। বারুইপুরের পদ্মপুকুর মধ্য বিদ্যালয়েও শিক্ষকের অভাব। এরকম আরও একাধিক শহরতলির স্কুলে শিক্ষক নেই।
শিক্ষকদের একাংশের মত অবশ্য অন্য। তাঁদের একাংশের মতে, বর্তমানে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার দায় কমেছে। গৃহশিক্ষকতার উপর নির্ভরতা এর একটা বড় কারণ। যেসকল পড়ুয়ারা সুবিধা পাচ্ছে তারা গৃহশিক্ষকের কাছে পঠন-পাঠনের সুবিধা গ্রহণ করছে। সেদিক থেকে শিক্ষকেরাও নিজেদের ‘রেস্ত’-এ নজর দিয়েছেন। কেরলের মতো রাজ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ ছেলেমেয়েই বেসরকারি স্কুল থেকে পড়াশোনা করে সেখানে বঙ্গে এই প্রবণতা প্রায় ৩ শতাংশ। অর্থাত্ বেশিরভাগই সরকারি স্কুলের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, তা হলে কী হবে! পড়ুয়াদের প্রয়োজনীয়তা মেটাতেও অক্ষম অধিকাংশ সরকারি স্কুলগুলি। যার জেরে এই বিপত্তি। এছাড়া, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট তো বরাবরই এ রাজ্যের শিক্ষায় কোপ হেনেছে।
প্রসঙ্গত, আদালত সূত্রে খবর, গোটা রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলির কী অবস্থা, তা জানতে চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। স্কুলগুলিতে ছাত্রের সংখ্যা পিছু কত শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছে? কতগুলি স্কুল রয়েছে, পড়ুয়াদের সংখ্যা কত, সমস্ত বিস্তারিত জানিয়ে রাজ্যকে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। জানা গিয়েছে, এই রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য রাজ্যের তরফে বেশি সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। জবাবে ভারপ্রাপ্ত বিচারপতির মন্তব্য, ‘ডেটা ছাড়াই রাজ্য স্কুল চালাচ্ছে! এটার জন্য একটা দিন যথেষ্ট। যদি সেই ডেটা না থাকে, তাহলে সেটা বিস্ময়কর!’ অন্য়দিকে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে পুজোর পরেই স্কুল খুলতে পারে বলে জানিয়েছেন মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: সকালে মাধ্যমিকের রেজাল্ট শুনেই কাউকে ফোন করেছিল রেশমা, দুপুরে ঘর থেকে উদ্ধার দেহ!