কমলেশ চৌধুরী: গজ-গমনে মেঘপুঞ্জ। ‘বানভাসি’ কলকাতা!
দুর্গার আসা-যাওয়া নিয়ে পঞ্জিকার তথ্য নয়, মঙ্গলবারের মুষলধারাকে কিছুটা এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছে হাওয়া অফিস। আবহবিদদের রিপোর্ট, এ দিন দুপুরে কলকাতা বা প্রতিবেশী জেলার উপর থাকা মেঘপুঞ্জ নড়াচড়া করেছে কম। সেই কারণেই সহসা থামেনি বৃষ্টি। ধারাবর্ষণে স্বস্তির সঙ্গে সঙ্গী তাই জমা জলের দুর্ভোগও।
রাজস্থান থেকে উত্তরবঙ্গ হয়ে অসম পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা ছিলই। এর সঙ্গে উদয় হয় উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত আরও একটি অক্ষরেখা। জোড়া অক্ষরেখার প্রভাবে একটানা জলীয় বাষ্প ঢুকছিল বঙ্গোপসাগর থেকে। তাই আগে-ভাগেই ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছিল আলিপুর আবহাওয়া দফতর। সেই পূর্বাভাস সত্যি প্রমাণিত করে সকাল থেকে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয় পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে। পরে বিভিন্ন জেলার উপর থাকা টুকরো টুকরো বজ্রগর্ভ মেঘপুঞ্জ একসঙ্গে জুড়ে যায়। তৈরি হয় মেঘ-মালা। আবহবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে, ‘স্কোয়াল লাইন’। ধীরে ধীরে এই মেঘ-মালা সরে আসে কলকাতা-সহ দুই ২৪ পরগনা, নদিয়ার দিকে। মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, উপমহানির্দেশক সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এপ্রিল-মে মাসের এই ধরনের মেঘপুঞ্জ সাধারণত দ্রুত সরে যায়। ফলে একটানা অনেকক্ষণ বৃষ্টি হয় না। মঙ্গলবারের মেঘপুঞ্জ দ্রুত সরেনি। গতি অত্যন্ত কম ছিল। ফলে একটানা প্রবল বৃষ্টি হয়েছে।”
মেঘ-মালার সৌজন্যে বৃষ্টি হয়েছে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায় দিঘা পর্যন্ত। শহরের আকাশে উল্লম্ব বজ্রগর্ভ মেঘপুঞ্জের উচ্চতা ছিল অন্তত ১০ কিলোমিটার। মেঘের মিনার যত উঁচু, তত দাপট বৃষ্টির।
অল্প সময়ে যে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে, তা ‘বানভাসি’ কলকাতার ছবিতেই স্পষ্ট। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আলিপুরে বৃষ্টি হয়েছে ১০২ মিলিমিটার। গত বছর ঘূর্ণিঝড় আমপানের দাপটে ২৪ ঘণ্টায় ২৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল আলিপুরে। মঙ্গলবারের বৃষ্টির পরিমাণ তার অর্ধেকেরও কম, কিন্তু ভেঙেছে মে মাসের প্রথমার্ধের রেকর্ড। ১-২ বছর নয়, ১৪ বছরের রেকর্ড। আবহাওয়া দফতরের দস্তাবেজ বলছে, ২০০৫ সালের ১১ মে ১০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল আলিপুরে। তার পর মে-র প্রথমার্ধে একদিনে এত বেশি এই প্রথম। তাত্পর্যপূর্ণ তথ্য, মে মাসে কলকাতায় গড়ে বৃষ্টি হওয়ার কথা ১৩৫ মিলিমিটার। সেই নিরিখে গোটা মাসের ৭৫% বৃষ্টি হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই।
আরও পড়ুন: জলমগ্ন রাস্তায় বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু ব্যক্তির, রাজভবনের সামনে ভয়াবহ দুর্ঘটনা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে এই ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কথাই বারবার বলেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, শুকনো দিনের সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাত্, একটানা অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়ার প্রবণতা। আবার অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টির প্রবণতাও বাড়ছে। এ বার গ্রীষ্মে দুই পরিস্থিতিরই সাক্ষী বাংলা। ফেব্রুয়ারির শেষাশেষি থেকে কালবৈশাখীর মরসুম শুরু হয়ে যায় বাংলায়। এ বার এপ্রিলের সিংহভাগ সময় পর্যন্ত একটিও কালবৈশাখী পায়নি কলকাতা। ফলে বৃষ্টিও প্রায় হয়নি। গরমও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। মে মাসে আবার অন্য ছবি। বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢুকে আসার মতো অনুকূল পরিস্থিতি থাকায় পর পর কালবৈশাখী পাচ্ছে শহর। মঙ্গলবারও দুপুর একটা ৫৫ মিনিট নাগাদ ঘণ্টায় ৫৪ কিলোমিটার বেগে কালবৈশাখী আছড়ে পড়ে আলিপুরে। তার পরই অল্প সময়ে ভারী বৃষ্টি। যার জেরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায় তাপমাত্রা।
বৈশাখী-সন্ধ্যায় চেনা প্যাচপেচে গরমের জায়গায় সোঁদা ঠান্ডার আবেশ, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
আরও পড়ুন: উল্টোডাঙায় ডুবল বাস, ঘণ্টা তিনেকের বৃষ্টিতে জলে থৈথৈ কলকাতা, দু’দিন চলবে বারিধারা