নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ৫
২৫০০ বছর আগে এক গ্রিক মেছো মহাপেটুকের তুর্কিতে চাখা ঝলসানো মাছ
মূল রেসিপি—
‘‘চ্যালসিডোন-এ সমুদ্র উপকূলে বড়সড় প্যারটফিশ ভাল করে বেক করুন আগে ভাল করে ধুয়ে। বাইজেন্টিয়াম শহরেও পাবেন দিব্যি একখানা, বড় মাপের, দেহ যেন গোল ঢাল একটা। গোটা মাছটাই রেঁধে ফেলুন এই ভাবে: চিজ় আর তেল দিয়ে ঢেকে ফেলে গরম চুল্লিতে ঝুলিয়ে দিন। এবার বেক করুন। মাখাতে থাকুন নুন, জিরে আর হলুদ-ধূসর তেলে গুলে, যাতে ঈশ্বরের নদীর মতো আপনার হাত থেকে ঝরে-ঝরে পড়ে।’’
—আরকেস্ট্রাটুস
মেছো বাঙালি। কথাটা ঠিক নিঃসন্দেহে। মাছ না হলে জাত বাঙালির চলে না। কিন্তু যদি কোনও এক ব্যক্তির মাছ-প্রীতির কথা বলতে হয়, যদি খুঁজতে হয় যাকে বলে ‘মেছো মানুষ’, তা হলে—আমি বলব—দুনিয়ার আর সক্কলকে যিনি টেক্কা দেবেন তিনি আদপেই বাঙালি নন। গ্রিক। প্রবাসী গ্রিক। তবে আজকের নয়, প্রায় হাজার আড়াই বছর আগের।
নামটা শুনেছিলাম। কিন্তু বইটা হাতে পেয়ে একেবারে থ’ হয়ে গেলাম। এমন বিচিত্র কেতাব দুনিয়াতে আর লেখা হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। চমকের পর চমক। প্রথমেই একটা ধারণা চুরচুর হল—‘কালিনারি ট্যুরিজম’, আমার ধারণা ছিল, বেশ হাল ফিলের ব্যাপার। আমি এবং বন্ধুবর দীপঙ্কর দাশগুপ্ত সেটা সুযোগ পেলেই করে থাকি বলে বন্ধু মহলে বেশ ভাল পিঠ-চাপড়ানি জোটে মাঝেসাঝে। সোজা বাংলায় ঘুরে-ঘুরে খাওয়া—মানে খাব বলেই ঘোরা। যেমন মিষ্টি। ভাবলে দেখা যাবে, বাঙালির মিষ্টির একচেটিয়া সুনাম কলকাতা ও অন্যান্য কয়েকটি শহরের হাতে গোণা কয়েকটি পরিবারের মধ্যে ঘুরপাক খায়। কিন্তু তার বাইরেও যে সাংঘাতিক সব মিষ্টান্ন ছড়িয়ে রয়েছে বঙ্গীয় আনাচে-কানাচে, এটা জিভে-টাকরায় বুঝে নেওয়াই আমার লক্ষ্য।
বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম পিয়ারডোবার পরিমলের দোকানের খাঁটি ঘিয়ের ল্যাংচা কিংবা কাঁথির বৃহস্পতির একরত্তি দোকানের কাজু-সন্দেশ (কাজু-বরফির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে মহাভুল হবে) চেখে বুঝেছি কী সম্পদ অনাস্বাদিত ছিল। তেমনই, দূর দেশে, ইরানের ইসফাহানের অ্যাজ়ম বেরিয়ানি রেস্তোরাঁয় যে ‘বেরিয়ান’ খেয়েছি (যার সঙ্গে বিরিয়ানির কোনও সম্পর্ক নেই) কিংবা গ্রিসের এথেন্সের আজ-নাম-না-মনে-থাকা একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁর উঠোনে ফটফটে জ্যোৎস্নায় ফিগ গাছের নীচে বসে মৌরিগন্ধী সফেদ পানীয় উজ়ো সহযোগে যে ‘মুসাকা’ আস্বাদন করেছি, তা-ও অপার্থিব।
কিন্তু সেই গ্রিক দেশের এক রসিক কবি আজ থেকে ২৪০০ বছর আগেই ‘কালিনারি ট্যুরিজম’-এর যে এমন বোঁ-করে-মাথা-ঘুরিয়ে-দেওয়া উদাহরণ রেখে গিয়েছেন তা তো জানলাম এই সেদিন। আর জেনেই বইটা কিনে ফেললাম—Fragments From The Life of Luxury. Archestratus. A Modern English Translation with an Introduction and Commentary John Willkins & Shaun Hill. আরকেস্ট্রাটুস। তাঁর বিষয়ে প্রায় কিছুই জানা যায় না। শুধু জানা যায় তিনি গ্রিক ছিলেন। পূর্বসাধারণাব্দ চতুর্থ শতকের মানুষ ছিলেন। দক্ষিণ ইতালির জেলা শহরে রসেবসে থাকতেন। আর একখানা লম্বা কবিতা লিখেছিলেন যার গ্রিক নাম ‘হেডাইপাথিয়া’, ইংরেজি তরজমায় ‘Life of Luxury’, বাংলায় বলতেই পারি ‘বিলাসী জীবন’। এমন একখানা কবিতা আর কেউ কখনও লিখেছেন বলে জানা যায় না— তার বিষয় সুখাদ্য। আরও ভেঙে বললে সুস্বাদু মাছ। হ্যাঁ, মাছ খেতে হাজার-হাজার কিলোমিটার ঢুঁড়ে বেড়িয়েছেন এমন কোনও দ্বিতীয় মানুষের কথা আর আমার জানা নেই। প্রবচন বলে ‘প্রেমে ও যুদ্ধে সবই বৈধ’। আরকেস্ট্রাটুস বলেন, ‘মাছ কিনতে যিনিই অক্ষম তাঁরই উচিত অপরাধ করে হলেও সে আকাঙ্খা পূরণ… যদি প্রাণ সংশয়ও হয়, যদি ওরা আপনাকে বিক্রি করতে অস্বীকার করে, কেড়ে নিন’!
আর তিনি এ কবিতা লিখতে ইতালি, গ্রিস, তুরস্ক, আয়োনিয়ান সাগর, এজিয়ান সাগর, কৃষ্ণসাগরের উপকূলে যাকে বলে চিরুনি-তল্লাশি চালিয়ে ছিলেন। এ অঞ্চলের কম সে কম পঞ্চাশটি শহরে গিয়ে সেখানকার খানা চেখে তার পরমস্বাদ নিয়ে কাব্যি করার কথা তো এ কেতাবের পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় জ্বলজ্বল করছে। ভাবছি, আরও কত শহরে বন্দরের খানার কথা তিনি লেখেনইনি পছন্দ হয়নি বলে। অবিশ্যি অপছন্দের কথাও কিছু-কিছু আছে, যেমন ক্রিট দ্বীপপুঞ্জের ছোট মাছ ‘চিমড়ে এবং শক্ত এবং ঢেউয়ে ঢেউয়ে ক্ষত বিক্ষত’। এ লেখার সঙ্গে দেওয়া মানচিত্রে তার সামান্য কিছু, মাত্র ন’টি শহরের নমুনা দিলাম। লাল দাগ দেওয়া জায়গাগুলি বিশেষ করে লক্ষ্য করুন। আজকের যুগে হণ্টন দিলে, যেমনটা দেখাচ্ছে গুগল ম্যাপ — ৩৬০০ কিলোমিটার।
আক্ষেপের কথা হল, এই যে বিচিত্র কবিতা, ‘বিলাসী জীবন’, তা কিন্তু পাওয়া যায়নি! তাহলে? পাওয়া গিয়েছে তার কিছু অংশ। অনেকটা আমাদের চার্বাকের দর্শনের মত। কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে মূল কবিতাটি। মন্দের ভাল এই যে, আরকেস্ট্রাটুসের জীবৎকালের প্রায় ছশো বছর পরে গ্রিক মহাবাগ্মী ও বৈয়াকরণ আথেনায়ুস (১৭০–২২৩ সাধারণাব্দ) একটি বিখ্যাত কেতাব লেখেন—ডেইপনোসোফিস্টায়ে, যার ইংরেজি করা হয়েছে ‘Philosophers at Dinner’ বা ‘ভোজসভায় দার্শনিকরা’। সে কেতাবখানাও কম বিচিত্র নয়। সুপণ্ডিত ও শিল্পকলার মহাবোদ্ধা পুবলিয়ুস লিভিয়ুস লারেনসিস নাকি তাঁর বাড়িতে একের পর এক ভোজসভার আয়োজন করেন। তাতে আমন্ত্রিত ছিলেন রোম সাম্রাজ্যের বাঘা-বাঘা সব দার্শনিক ও পণ্ডিতেরা। আথেনায়ুস এই ভোজসভার বর্ণনা দিচ্ছেন তাঁর বন্ধু টিমোক্রাটেসকে। সেই বর্ণনাই হল এই কেতাব—‘ভোজসভায় দার্শনিকেরা’। মানে বইটা আসলে সংলাপের মধ্যে সংলাপ। জটিল ব্যাপার স্যাপার। সেই বইতে আথেনায়ুস ৬২ জায়গায় আরকেস্ট্রাটুসের সেই বিখ্যাত কবিতাটির কিছু-কিছু অংশ উদ্ধৃত করেন। সেইগুলি দুই মলাটের মধ্য একত্রিত করে, তার সঙ্গে দীর্ঘ টীকা জুড়ে তৈরি হয়েছে আমাদের আলোচনার আধুনিক ইংরেজি কেতাবটি—Fragments From The Life of Luxury।
সেই বই থেকেই আমরা নিয়েছি আমাদের এই রেসিপিটি। এবার তাহলে বোঝা দরকার, এ খানা তা হলে কোন সাম্রাজ্যের? এটা আন্দাজ করতে হলে একটু শার্লক হোম্স হতে হবে। পড়তে হবে আরকেস্ট্রাটুস থেকে নেওয়া আথেনায়ুসের ২০ নম্বর উদ্ধৃতি, যাতে আছে ‘গ্রে-ফিশ’ নামের এক মাছের কথা—‘‘কিন্তু আমাকে কিনে দিন গ্রে-ফিশের মুড়ো অলিন্থস আর মেগারা-তে। কারণ সেই পবিত্র অগভীর সমুদ্রেই ধরা হয় সেই মাছ।’’
আমাদের লোক গানে আছে —‘‘তালৈ যাইলা বাজারে তার গাঁটিক নাইরে কড়ি / মাইয়োর পরাণে মাগে বোয়াল মাছের মুড়ি।’’ আর আমাদের ঘটি হাফ-মেছোরা বলবেন—কাতলা মাছের মাথা ছাড়া মুড়িঘণ্ট হয় নাকি? খাস বাঙ্গাল কইবেন, ধুর! আমাগো চাই রুই মাছের মুড়া! একটা ধারণা আমার মনে গজিয়েছিল পশ্চিমী, মানে মূলত ব্রিটেন আর মার্কিন মুলুকের কিছু মাছের বাজারে ঘুরে—মুড়োর কদর করতে ব্যাটারা এখনও শেখেনি। পষ্টতই মহামেছো আরকেস্ট্রাটুসকে এ বদনাম দেওয়া যাবে না। কিন্তু মুড়ো নয়, এ উদ্ধৃতিতে আমাদের নজর রাখতে হবে একটা শহরের নামের ওপর—অলিন্থস। এই অলিন্থস ছিল গ্রিক সাম্রাজ্যের এক ডাকসাইটে শহর। পূর্বসাধারণাব্দ সপ্তম শতকে এর পত্তন করা হয়। তারপর দুনিয়া-দাপিয়ে-বেড়ানো আলেকজান্ডারের বাপ ম্যাসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ (৩৮২–৩৩৬ পূর্বসাধারণাব্দ) এ শহর এক্কেবারে ধ্বংস করে দেন ৩৪৮ পূর্বসাধারণাব্দে। কাজেই, আরকেস্ট্রাটুস নির্ঘাত এ শহরে এসেছিলেন তার আগেই। কাজেই, আরকেস্ট্রাটুস টৈটৈ করে দুনিয়া জুড়ে মাছ চেখে বেড়াচ্ছিলেন আলেকজান্ডারের বাবার আমলেরও কিছু আগে। মানে ৩০০ পূর্বসাধারণাব্দের প্রথম ভাগে।
তার মানে আরকেস্ট্রাটুসের সময়টা হল ম্যাসিডোনিয়া সাম্রাজ্যের উত্থানের একটু আগে। সে সময় গ্রিস অঞ্চলে দাপট এথেন্স, স্পার্টা এবং থেবেস শহর-রাষ্ট্রের। এমত সময়ে গ্রিসে খুব ভাল চাষবাস হত না। বেশ গরিব দেশই ছিল। সেই তুলনায় সিসিলি ছিল সুজলা-সুফলা। ডাকসাইটে বহু গ্রিকই তখন সিসিলিতে পেল্লায় ভিলা হাঁকিয়ে পাকাপাকি ভাবে উঠে গিয়েছিলেন।
আরকেস্ট্রাটুসও তেমন একজন হয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর সিসিলি যে যুগ-যুগ ধরে মহাপেটুকদের পীঠস্থান, তা তো আরকেস্ট্রাটুসের অনেক আগেই বলে গিয়েছেন স্বয়ং সোক্রাতিস (৪৭০–৩৯৯ পূর্বসাধারণাব্দ)—‘সিসিলীয় রন্ধনপ্রণালীর সেই সব সূক্ষ্মতা যার জন্য বিখ্যাত সাইরাকিউসের টেবিল’।
কিন্তু আরকেসট্রাটুসের দিনকাল খুব খুশহাল ছিল না সম্ভবত। পূর্বসাধারণাব্দ চতুর্থ শতকে ভূমধ্যসাগর ছিল নানা বিপদে ভরপুর। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভয়াল নানা সমুদ্দুর পাড়ি দেওয়ার স্বাভাবিক বিপদ বাদ দিলেও, মনে রাখতে হবে উত্তর আফ্রিকার কার্থাজিনীয় সাম্রাজ্য তখন কথায়-কথায় হামলা করছে সিসিলি-ইতালির ওপর। সাইরাকিউসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রথম ডিয়োনিসিয়ুসও খড়্গহস্ত সিসিলির ওপর। আজকের তুরস্ক পারসিক সম্রাটদের সৈন্যবাহিনীর হুঙ্কারে তটস্থ। এজিয়ান উপকূলের গ্রিক শহরগুলির দখল নিচ্ছে ম্যাসিডোনিয়া।
কল্পনা করুন, এরই মধ্যে এ ভদ্রলোক দলবল নিয়ে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাছ খেয়ে-খেয়ে। তাঁর বাতলানো পাকপ্রণালী পরমান্ন না হয়ে যায়?
কী ভাবে আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্ত হেঁশেলে করা যাবে এ রান্না? পড়ে রেঁধে ফেলুন, আগামিকাল, রবিবার।