নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ১
প্রথম পাত
মাঝে মাঝেই আমি এক একটা খানার রেসিপি দেখি আর বুকের মধ্যে ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে যায়।আর প্রায়শই তা শেষ হয় এক্কেবারে পেগেসাস ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার আনন্দঘন স্বাদে, এক টুকরো তুলে মুখে দেওয়া মাত্র। এই যে সিরিজের প্রত্যেকটা কাহিনি ওই রেসিপি থেকে সেই স্বাদের যাত্রাপথ।শীঘ্রই আমরা দেখব সে পথ কী রঙিন আর রোমহর্ষক।
এক একটি খানদানি খানা যেন সারা থালা জুড়ে দুনিয়াটাই সাজানো—কোথাও তার প্রবল উত্তাল সমুদ্দুরে মাঝিমাল্লাদের শোরগোল, কোথাও দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার করতে থাকা কাফেলার গলার ঘণ্টি আর হট্টগোগোল, কোথাও বিস্তীর্ণ প্রান্তরে শান্ত মশলা ক্ষেতে রমণীদেরহাসি-মসকরার কলকল।
ভাল কথা, এখানে যে রান্নার কথা আমি বলব, তার প্রত্যেকটি নিজে হাতে রেঁধে, নিজমুখে চেখে দেখেছি! আগ্রহ থাকলেই এ সব খানা আপনিও দিব্যি রেঁধে ফেলতে পারেন।
খানা ১
মিনুটাল মাটিয়ানুম
(আপেল সহযোগে বরাহমাংস)
মূল রেসিপি:
সস্প্যানে তেল, মাছের সস্ আর স্টক দিন। পেঁয়াজ কুচি, ধনে, ছোট-ছোট মিটবল। শুয়োরের কাঁধের সিদ্ধ করা মাংস চৌকো করে কেটে নিন (চামড়ার চর্বির প্রলেপ থাকবে)। সব এক সঙ্গে সিদ্ধ করুন। রান্নার মাঝপথে বীজ-ছাড়ানো চৌকো করে কাটা আপেল দিন। সিদ্ধ যখন হচ্ছে, গোলমরিচ, জিরে, তাজা ধনে বা ধনের বীজ, পুদিনা, হিং গুঁড়ো করে নিন।ভিনিগার, মধু, মাছের সস্, সামান্য ঘন মাস্ট্ এবং কিছুটা রান্নার লিকার ঢালুন।দরকার মতো ভিনিগার দিয়ে গন্ধ পছন্দমতো করুন। ফুটে ওঠা পর্যন্ত গরম করুন। ফুটে উঠলে পেস্ট্রি গুঁড়ো করে মিশান সস্ ঘন করতে। গোলমরিচ ছড়ান। পরিবেশন করুন।’’
যে মূল রোমান সূত্র থেকে এই রেসিপিটি নেওয়া, সেই খানা-কেতাবখানার নাম ‘আপিকিউস’। লাতিন ভাষায় লেখা সে পাকপ্রণালীর বই থেকে এটি পাচার করা হয়েছে The Classical Cookbook নামের একটি অসামান্য ইংরেজি বইতে। আমাদের আলোচনা, গালগপ্পো, রান্না-বান্না সেই বইটিকে সামনে রেখে। এ কেতাবের লেখক (সংকলক ও টীকাকার বলাই শ্রেয়) অ্যান্ড্রু ড্যালবি এবং স্যালি গ্রেইঙ্গার।প্রথম প্রকাশ ১৯৯৬ সালে। সেই বছরই দুই দেশে দুই সংস্থা বইটি প্রকাশ করে। ব্রিটেনে, লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম। এবং মার্কিন মুলুকে, জে পল গেটি মিউজিয়াম, মালিবু, ক্যালিফোর্নিয়া।
বইয়ের মূল বিষয় কী? গ্রিক ও রোম সাম্রাজ্যের খানা। এ খানার ইংরেজি নাম— Pork With Apple। মূল লাতিন নামটি হল— Minutal Matianium। মিনুটাল মাটিয়ানিয়ুম। ইংরেজি কেতাবটির আর একটা দুরন্ত আকর্ষণ হল, প্রত্যেক রেসিপির শেষে, তা নিয়ে লেখকদ্বয়ের নানা টিপ্পনি।যেমন, প্রশ্ন উঠেছে, ওই লাতিন নাম মাটিয়ানিয়ুম কেন হল?
তবে কি তা আসলে গাইয়ুস মাটিয়ুস মহাশয়ের হেঁশেলের খানা? আমাদের দেশের মতোই বিখ্যাত লোকেদের নামে খানার নাম দুনিয়ার বহু দেশেই দেখেছি। যেমন খিচুড়ির তাক লাগানো ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে পেয়েছি শাহ জাহানের হেঁশেলে খিচড়ি দাউদখানি। দাউদ খান নামটা চেনা কঠিন নয়।এ জিনিস অন্য দেশেও চলে, বিখ্যাত বেশামেল সস্ ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের চিফ স্টেওয়ার্ট লুই দ্য বেশামেলের নামে নামাঙ্কিত বলেই কথিত।তবে এই ধারায় সব থেকে তাক লাগানো নামটি আমি পেয়েছি অটোমান রাজহেঁশেলে—ইমাম বায়িল্দি! ইমাম অজ্ঞান!! আসলে বেগুন পোড়া! কিন্তু সে গপ্পো অন্যত্র। এ ক্ষেত্রে অবশ্য নামটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা থেকে খানাটার প্রাচীনতার একটা আন্দাজ মেলে বইকি। যদি সত্যিই এ খানা গাইয়ুস মাটিয়ুসের হেঁশেল থেকে এসে থাকে, তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় রোমান মহাপাচকেরা এটি তৈরি করেছিলেন পূর্বসাধারণাব্দ প্রথম শতকে, মানে আজ থেকে কম-বেশি দু’হাজার একশো বছর আগে। রোমান বিত্তবান ‘নাগরিক’ মাটিয়ুসের জন্ম-মৃত্যু তারিখ জানা যায় না সুনিশ্চিতভাবে, কিন্তু যা জানা যায় তা হল, তিনি গাইয়ুস ইউলিয়ুস কায়সার (আমাদের উচ্চারণে—জুলিয়াস সিজার)-এর এবং তাঁর নাটকীয় হত্যার ১৭ বছর পর রোম সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট, গাইয়ুস অগুস্টুস-এর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তাঁর জীবৎকাল ১০৬ থেকে ৪৩ পূর্বসাধারণাব্দ।
কাজেই ‘আপেল সহযোগে বরাহমাংস’ খানাটি যে কী সাংঘাতিক সময়ের সাক্ষী তা কল্পনা করলে বুকের মধ্যে ঘোড়দৌড় হবে না? আরও আছে। The Classical Cookbook কেতাবে স্পষ্টই বলা আছে এখানে এ খানাটি নেওয়া অন্য একটি সংকলন থেকে—আপিকিউস। সে আরেক রোমহর্ষক মহাকেতাব।সৌভাগ্য, সে কেতাবও শোভিত মম তাকে! ইংরেজি তরজমায়। তার আসল পোশাকি নাম—Apicius de re Coquinaria। আপিকিউস— রন্ধন বিষয়ক।দশটি বিভাগে বিভক্ত এ কেতাবকেই ধরা হয় দুনিয়ার প্রথম কুকবুক। বইটি লেখা চলতি লাটিনে। ‘আপিকিউস’ খুলে দেখি, তারও ১৬৭ নম্বর পদটির নাম—মিনুটাল মাটিয়ানুম। এ কেতাব যাঁর নামে নামাঙ্কিত সেই মার্কুস গাভিয়ুস আপিকিয়ুস এমন এক রঙিন চরিত্র, দুনিয়ার ইতিহাসে যার জুড়ি মেলা ভার। ইনি সম্রাট টাইবেরিয়ুসের সমসাময়িক। তাঁর রাজত্ব ১৪ থেকে ৩৭ সাধারণাব্দ। আবার মার্কাস গাভিয়ুসের কম সে কম শত খানেক বছর আগে আর এক মহাভোজনরসিক ‘আপিকিয়ুস’ ছিলেন, সেই থেকে ডাকসাইটে ভোজনরসিক রোমান নাগরিকদেরই বলা হতো ‘আপিকিয়ুস’। আপিকয়ুসের বেঁচে থাকার কারণ ছিল সুখাদ্য। কেমন সেই খানা বিলাস?
গ্রিক মহাবাগ্মী আথেনাউয়ুস (জীবৎকাল ২০০ সাধারণাব্দ) লিখেছেন, ‘‘আপিকিয়ুস নামে একজন ছিলেন।… তিনি তাঁর উদরের উপর অন্তহীন দ্রাখমা খরচ করতেন, প্রধানত কাম্পানিয়ার শহর মিন্টুরি-তে থেকে, সাংঘাতিক দামি ক্রফিশ (এক ধরনের গলদা চিংড়ি) খেয়ে।… একবার তাঁর কানে এল আফ্রিকায় বিপুলাকার গলদা চিংড়ি পাওয়া যায়, শুনেই তিনি সেই উদ্দেশে রওনা দিলেন, আর একটি দিনও অপেক্ষা না করে, এবং সে সমুদ্রযাত্রায় তাঁকে সহ্য করতে হলো নিদারুণ কষ্ট। কিন্তু তিনি উপকূলের কাছে আসতেই, সেখানে নামার আগেই… সেখানকার জেলেরা তাঁর কাছে নৌকো বেয়ে এসে তাঁকে খুব ভাল গলদা চিংড়ি দেখাল। তাই দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এর থেকেও ভাল কিছু আছে কি না। তারা জানাল যা আনা হয়েছে, তার থেকে ভাল আর কিছু নেই। সেই না শুনে… তিনি ডাঙার ধারে পাশে না গিয়ে জাহাজের সারেংকে বললেন সোজা ইতালি ফিরে যেতে!’ শেষে একদিন এমন সময় এল যখন এ হেন আপিকিয়ুস দেখলেন তাঁর কোষাগারে পড়ে রয়েছে এক কোটি সেস্টেরটিই (রোমাণ স্বর্ণমুদ্রা), পাছে তাঁর আর মনোমত সুখাদ্য ভোজনের সাধ্য না থাকে, এই ভয়ে এক বিশাল ভোজের আয়োজন করলেন। সেই ভোজের অনির্বচনীয় স্বাদের সুখাদ্য খেতে খেতে খানার সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তা খেয়ে আত্মহত্যা করলেন! রোমান মহাভোজ ছিল এক সাংঘাতিক ব্যাপার—যেমনটি দেখা যেতে পারে এই অসাধারণ তথ্যচিত্রটিতে। যা লক্ষ্য করার মতো, রোমান মহাভোজে আপ্যায়িতরা বসে বা দাঁড়িয়ে নয়, খানা খেতেন আধশোয়া হয়ে গায়ে এলিয়ে—
তবে এনসাক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা জানাচ্ছে, ‘চতুর্থ শতকের আগে আপিকিয়ুস, যার পোশাকি নাম ডে রে কোকিনারিয়া (রন্ধনশিল্প বিষয়ক), সংকলিত হয়নি।’ কাজেই আমি তাকেই প্রামাণ্য মানছি।মানে আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে! গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, মশাই!
(পরবর্তী অংশ আগামিকাল, রবিবার)
খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ১
প্রথম পাত
মাঝে মাঝেই আমি এক একটা খানার রেসিপি দেখি আর বুকের মধ্যে ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে যায়।আর প্রায়শই তা শেষ হয় এক্কেবারে পেগেসাস ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার আনন্দঘন স্বাদে, এক টুকরো তুলে মুখে দেওয়া মাত্র। এই যে সিরিজের প্রত্যেকটা কাহিনি ওই রেসিপি থেকে সেই স্বাদের যাত্রাপথ।শীঘ্রই আমরা দেখব সে পথ কী রঙিন আর রোমহর্ষক।
এক একটি খানদানি খানা যেন সারা থালা জুড়ে দুনিয়াটাই সাজানো—কোথাও তার প্রবল উত্তাল সমুদ্দুরে মাঝিমাল্লাদের শোরগোল, কোথাও দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার করতে থাকা কাফেলার গলার ঘণ্টি আর হট্টগোগোল, কোথাও বিস্তীর্ণ প্রান্তরে শান্ত মশলা ক্ষেতে রমণীদেরহাসি-মসকরার কলকল।
ভাল কথা, এখানে যে রান্নার কথা আমি বলব, তার প্রত্যেকটি নিজে হাতে রেঁধে, নিজমুখে চেখে দেখেছি! আগ্রহ থাকলেই এ সব খানা আপনিও দিব্যি রেঁধে ফেলতে পারেন।
খানা ১
মিনুটাল মাটিয়ানুম
(আপেল সহযোগে বরাহমাংস)
মূল রেসিপি:
সস্প্যানে তেল, মাছের সস্ আর স্টক দিন। পেঁয়াজ কুচি, ধনে, ছোট-ছোট মিটবল। শুয়োরের কাঁধের সিদ্ধ করা মাংস চৌকো করে কেটে নিন (চামড়ার চর্বির প্রলেপ থাকবে)। সব এক সঙ্গে সিদ্ধ করুন। রান্নার মাঝপথে বীজ-ছাড়ানো চৌকো করে কাটা আপেল দিন। সিদ্ধ যখন হচ্ছে, গোলমরিচ, জিরে, তাজা ধনে বা ধনের বীজ, পুদিনা, হিং গুঁড়ো করে নিন।ভিনিগার, মধু, মাছের সস্, সামান্য ঘন মাস্ট্ এবং কিছুটা রান্নার লিকার ঢালুন।দরকার মতো ভিনিগার দিয়ে গন্ধ পছন্দমতো করুন। ফুটে ওঠা পর্যন্ত গরম করুন। ফুটে উঠলে পেস্ট্রি গুঁড়ো করে মিশান সস্ ঘন করতে। গোলমরিচ ছড়ান। পরিবেশন করুন।’’
যে মূল রোমান সূত্র থেকে এই রেসিপিটি নেওয়া, সেই খানা-কেতাবখানার নাম ‘আপিকিউস’। লাতিন ভাষায় লেখা সে পাকপ্রণালীর বই থেকে এটি পাচার করা হয়েছে The Classical Cookbook নামের একটি অসামান্য ইংরেজি বইতে। আমাদের আলোচনা, গালগপ্পো, রান্না-বান্না সেই বইটিকে সামনে রেখে। এ কেতাবের লেখক (সংকলক ও টীকাকার বলাই শ্রেয়) অ্যান্ড্রু ড্যালবি এবং স্যালি গ্রেইঙ্গার।প্রথম প্রকাশ ১৯৯৬ সালে। সেই বছরই দুই দেশে দুই সংস্থা বইটি প্রকাশ করে। ব্রিটেনে, লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম। এবং মার্কিন মুলুকে, জে পল গেটি মিউজিয়াম, মালিবু, ক্যালিফোর্নিয়া।
বইয়ের মূল বিষয় কী? গ্রিক ও রোম সাম্রাজ্যের খানা। এ খানার ইংরেজি নাম— Pork With Apple। মূল লাতিন নামটি হল— Minutal Matianium। মিনুটাল মাটিয়ানিয়ুম। ইংরেজি কেতাবটির আর একটা দুরন্ত আকর্ষণ হল, প্রত্যেক রেসিপির শেষে, তা নিয়ে লেখকদ্বয়ের নানা টিপ্পনি।যেমন, প্রশ্ন উঠেছে, ওই লাতিন নাম মাটিয়ানিয়ুম কেন হল?
তবে কি তা আসলে গাইয়ুস মাটিয়ুস মহাশয়ের হেঁশেলের খানা? আমাদের দেশের মতোই বিখ্যাত লোকেদের নামে খানার নাম দুনিয়ার বহু দেশেই দেখেছি। যেমন খিচুড়ির তাক লাগানো ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে পেয়েছি শাহ জাহানের হেঁশেলে খিচড়ি দাউদখানি। দাউদ খান নামটা চেনা কঠিন নয়।এ জিনিস অন্য দেশেও চলে, বিখ্যাত বেশামেল সস্ ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের চিফ স্টেওয়ার্ট লুই দ্য বেশামেলের নামে নামাঙ্কিত বলেই কথিত।তবে এই ধারায় সব থেকে তাক লাগানো নামটি আমি পেয়েছি অটোমান রাজহেঁশেলে—ইমাম বায়িল্দি! ইমাম অজ্ঞান!! আসলে বেগুন পোড়া! কিন্তু সে গপ্পো অন্যত্র। এ ক্ষেত্রে অবশ্য নামটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা থেকে খানাটার প্রাচীনতার একটা আন্দাজ মেলে বইকি। যদি সত্যিই এ খানা গাইয়ুস মাটিয়ুসের হেঁশেল থেকে এসে থাকে, তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় রোমান মহাপাচকেরা এটি তৈরি করেছিলেন পূর্বসাধারণাব্দ প্রথম শতকে, মানে আজ থেকে কম-বেশি দু’হাজার একশো বছর আগে। রোমান বিত্তবান ‘নাগরিক’ মাটিয়ুসের জন্ম-মৃত্যু তারিখ জানা যায় না সুনিশ্চিতভাবে, কিন্তু যা জানা যায় তা হল, তিনি গাইয়ুস ইউলিয়ুস কায়সার (আমাদের উচ্চারণে—জুলিয়াস সিজার)-এর এবং তাঁর নাটকীয় হত্যার ১৭ বছর পর রোম সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট, গাইয়ুস অগুস্টুস-এর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তাঁর জীবৎকাল ১০৬ থেকে ৪৩ পূর্বসাধারণাব্দ।
কাজেই ‘আপেল সহযোগে বরাহমাংস’ খানাটি যে কী সাংঘাতিক সময়ের সাক্ষী তা কল্পনা করলে বুকের মধ্যে ঘোড়দৌড় হবে না? আরও আছে। The Classical Cookbook কেতাবে স্পষ্টই বলা আছে এখানে এ খানাটি নেওয়া অন্য একটি সংকলন থেকে—আপিকিউস। সে আরেক রোমহর্ষক মহাকেতাব।সৌভাগ্য, সে কেতাবও শোভিত মম তাকে! ইংরেজি তরজমায়। তার আসল পোশাকি নাম—Apicius de re Coquinaria। আপিকিউস— রন্ধন বিষয়ক।দশটি বিভাগে বিভক্ত এ কেতাবকেই ধরা হয় দুনিয়ার প্রথম কুকবুক। বইটি লেখা চলতি লাটিনে। ‘আপিকিউস’ খুলে দেখি, তারও ১৬৭ নম্বর পদটির নাম—মিনুটাল মাটিয়ানুম। এ কেতাব যাঁর নামে নামাঙ্কিত সেই মার্কুস গাভিয়ুস আপিকিয়ুস এমন এক রঙিন চরিত্র, দুনিয়ার ইতিহাসে যার জুড়ি মেলা ভার। ইনি সম্রাট টাইবেরিয়ুসের সমসাময়িক। তাঁর রাজত্ব ১৪ থেকে ৩৭ সাধারণাব্দ। আবার মার্কাস গাভিয়ুসের কম সে কম শত খানেক বছর আগে আর এক মহাভোজনরসিক ‘আপিকিয়ুস’ ছিলেন, সেই থেকে ডাকসাইটে ভোজনরসিক রোমান নাগরিকদেরই বলা হতো ‘আপিকিয়ুস’। আপিকয়ুসের বেঁচে থাকার কারণ ছিল সুখাদ্য। কেমন সেই খানা বিলাস?
গ্রিক মহাবাগ্মী আথেনাউয়ুস (জীবৎকাল ২০০ সাধারণাব্দ) লিখেছেন, ‘‘আপিকিয়ুস নামে একজন ছিলেন।… তিনি তাঁর উদরের উপর অন্তহীন দ্রাখমা খরচ করতেন, প্রধানত কাম্পানিয়ার শহর মিন্টুরি-তে থেকে, সাংঘাতিক দামি ক্রফিশ (এক ধরনের গলদা চিংড়ি) খেয়ে।… একবার তাঁর কানে এল আফ্রিকায় বিপুলাকার গলদা চিংড়ি পাওয়া যায়, শুনেই তিনি সেই উদ্দেশে রওনা দিলেন, আর একটি দিনও অপেক্ষা না করে, এবং সে সমুদ্রযাত্রায় তাঁকে সহ্য করতে হলো নিদারুণ কষ্ট। কিন্তু তিনি উপকূলের কাছে আসতেই, সেখানে নামার আগেই… সেখানকার জেলেরা তাঁর কাছে নৌকো বেয়ে এসে তাঁকে খুব ভাল গলদা চিংড়ি দেখাল। তাই দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এর থেকেও ভাল কিছু আছে কি না। তারা জানাল যা আনা হয়েছে, তার থেকে ভাল আর কিছু নেই। সেই না শুনে… তিনি ডাঙার ধারে পাশে না গিয়ে জাহাজের সারেংকে বললেন সোজা ইতালি ফিরে যেতে!’ শেষে একদিন এমন সময় এল যখন এ হেন আপিকিয়ুস দেখলেন তাঁর কোষাগারে পড়ে রয়েছে এক কোটি সেস্টেরটিই (রোমাণ স্বর্ণমুদ্রা), পাছে তাঁর আর মনোমত সুখাদ্য ভোজনের সাধ্য না থাকে, এই ভয়ে এক বিশাল ভোজের আয়োজন করলেন। সেই ভোজের অনির্বচনীয় স্বাদের সুখাদ্য খেতে খেতে খানার সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তা খেয়ে আত্মহত্যা করলেন! রোমান মহাভোজ ছিল এক সাংঘাতিক ব্যাপার—যেমনটি দেখা যেতে পারে এই অসাধারণ তথ্যচিত্রটিতে। যা লক্ষ্য করার মতো, রোমান মহাভোজে আপ্যায়িতরা বসে বা দাঁড়িয়ে নয়, খানা খেতেন আধশোয়া হয়ে গায়ে এলিয়ে—
তবে এনসাক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা জানাচ্ছে, ‘চতুর্থ শতকের আগে আপিকিয়ুস, যার পোশাকি নাম ডে রে কোকিনারিয়া (রন্ধনশিল্প বিষয়ক), সংকলিত হয়নি।’ কাজেই আমি তাকেই প্রামাণ্য মানছি।মানে আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে! গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, মশাই!
(পরবর্তী অংশ আগামিকাল, রবিবার)
খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস