
উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু ছোট ছোট গ্রামে আমার সঙ্গে আপনারা ঘুরেছেন, যেখানে সবুজ বন, কমলা বাগান এবং প্রসারিত চা বাগান রয়েছে। সুন্দর কটেজ বা টেন্টে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতাও আছে। তাই এইসব শান্ত এবং শান্তিপূর্ণ জায়গা কলকাতা থেকে খুব ভাল সপ্তাহান্তের গন্তব্য হিসাবে কাজ করতে পারে। তাই চলুন মোটরসাইকেল ডায়েরির এই পর্বে আমরা বেরিয়ে পড়ি পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে আরও একটু উত্তরে সিকিমের একটি ছোট্ট গ্রামে। যেখানে আজও মেলে লেপচা জগতের মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতির বৈচিত্র। দার্জিলিং, গ্যাংটক এর মতো বড় শহরের যেভাবে পর্যটকের ভিড় এবং স্থানীয় মানুষরা যেভাবে পর্যটকদের লুটপাট করছে, তাই চলুন আজকে এই সব মানুষের থেকে একটু দূরে প্রকৃতি এবং একটি ভাল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ঘুরে আসি যেখানে তাদের অতিথি আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। যেখানে পাবেন শিকার করা পশুর ছাল এবং তাদের হাড় দিয়ে তৈরি করে আসবাসপাত্র।
জঙ্গু সম্পর্কে জানতে এই ব্লগটি পড়ুন, সেখানে কীভাবে পৌঁছাবেন, কোথায় থাকবেন, কোথায় টেন্ট খাটাবেন, কী করবেন এবং এই বিস্ময়কর হিমালয়ের গ্রামে বাইক নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। অফবিট জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা, সবাই যে ভাবে ঘোরে সে ভাবে নয়, আপনাদের এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেগুলি বেশ অনন্য এবং সুন্দর। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সাথে থাকার অভিজ্ঞতা। এই স্থানে আসার জন্য আপনাকে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় হাতে নিয়ে আসতে হবে এছাড়াও এই গ্রামে প্রবেশ করার জন্য আপনাকে সিকিম সরকারের কাছ থেকে পারমিশানে নিতে হবে যা আপনি মাঙ্গান এ পেয়ে যাবেন। এই স্থানগুলির সৌন্দর্য কেবল ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এটি একটি মনোরম দৃশ্য এবং প্রশান্তি সহ একাধিক ছোট ছোট গ্রাম, যা সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন শহরের জীবনে পাওয়া যায় না। সিকিমের নানা গ্রাম এবং মানুষের উপর গবেষণা করে এই ধরনের ছোট ছোট গ্রামগুলির কথা জানতে পারি।
জঙ্গু হল সিকিমের একটি বিশাল বড় অঞ্চলের নাম, যেটি ছোট ছোট অনেক গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়েছে। যেটা গ্যাংটক থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার উত্তরে এবং শিলিগুড়ি শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে আসতে গেলে আপনাকে হাতে সময় নিয়ে আসতেই হবে, তার কারণ জঙ্গু আসতে গেলে আরও কিছু গ্রাম যেমন লিঙথেম, মান্তম, তিনভং ইত্যাদি। এখানের প্রতিটি গ্রামে সুন্দর।
শুক্রবার তাড়াতাড়ি অফিস করে দুপুরের মধ্যে অফিসের কাজ গুছিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন জঙ্গুর উদ্দেশ্যে, যা কলকাতা থেকে ৭২৫ কিলোমিটারের দূরত্ব। জানি একদিনে জঙ্গু পৌঁছানো যাবে না. কিন্তু রাতের দশটা থেকে বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন মালদা। কলকাতা থেকে মালদার দূরত্ব ৩৫০ কিলোমিটার। মালদার বাইপাস দিয়ে সিটি ক্রস করে রাস্তার দুপাশে দেখবেন অনেক ধাবা বা হোটেল আছে সেখানেই রাতের খাবার খেয়ে তিন চার ঘন্টা রেস্ট নিয়ে নিতে পারেন। তার কারণ মালদার পরে সেরকম ভাল জায়গা নেই থাকার মত। তারপর ভোর চারটের সময় বেরিয়ে পড়ুন জঙ্গুর উদ্দেশ্যে। রায়গঞ্জ, ডালখোলা, কিশংগঞ্জ হয়ে তারপর শিলিগুড়ি ও সেবক রোড ধরে কালিম্পং তারপর রংপু হয়ে সোজা মাঙ্গান। এভাবে আমি নিজেও অনেকবার বাইক নিয়ে এসেছি। এতে আপনি একটা দিন অতিরিক্ত হাতে পেয়ে যাবেন। রাতে একটু ঘুম কম হবে ঠিকই এরই সঙ্গে যখন লিঙ্গথেমর ভিলেজে পৌঁছাবেন তখন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। দুপুরের মধ্যে মাঙ্গানে পৌঁছে পারমিট করে (মাথাপিছু ১০০ টাকা) পৌঁছে যান সুন্দর ছোট্ট একটি গ্রাম লিঙ্গথেমে। এখানে আসলে আগে থেকে বুকিং করে আসবেন, এছাড়াও আপনি নিজেও সুন্দর একটি জায়গা দেখে টেন্ট খাটাতে পারেন। এখানে আসার আদর্শ সময় নভেম্বর মাস। এই সময় প্রকৃতি পাকা ধানে সোনালি হয়ে থাকে। এখানের মানুষেরা আজও একে অপরের কাজ সবাই মিলেই করে থাকে।
লিঙ্গথেম যাওয়ার রাস্তা ছিল বেশ সুন্দর এবং সবুজ পাহাড়ে ঘেরা আঁকাবাঁকা রাস্তা। এটি এমন একটি সুন্দর জায়গা, এখানে আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, কোন অভিযোগ করতে পারবেন না। এখানে ছোট ছোট কটেজ গুলোতে থাকতে খুবই ভালো লাগে। স্থানটিতে জড়িয়ে আছে লেপচা সংস্কৃতির ছোঁয়া। এখানে হোটেল গুলোতে প্রতিদিনের মাথাপিছু পনেরশো টাকা নিয়ে থাকে (থাকা এবং খাওয়া)। এখানের আঞ্চলিক মানুষের এতটাই ভাল তারা নিজেরাই পুরো গ্রামগুলি এবং তাদের সম্বন্ধে বলে থাকে। এখানে আসলে আপনি কী-কী দেখবেন এসব তাদের মুখেই শুনতে পারবেন। প্রতিটি বাড়ির সামনে ফুল এবং অর্কিডের বাগানে বাড়িগুলিকে অদ্ভুত এবং মনোরম লাগছিল।
এখানে পৌঁছে পরের দিন আশেপাশে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের সম্বন্ধে জেনে প্রথমে বেরিয়ে পড়ুন মান্তম লেকের উদ্দেশ্যে। এখানে পাবেন তিস্তা নদীর উপরে গড়ে ওঠা ২০০ মিটার লম্বা একটি ঝুলন্ত ব্রিজ এবং তার পাশে অবস্থিত আরেকটি ছোট বাঁশের তৈরি ব্রিজ। যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করতে প্রায় সবাই এখানে এসে থাকে। এরপরে চলে আসুন মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তিনভং মনেস্ট্রি। এই গ্রাম থেকে মনেস্ট্রিতে ওঠার একটি শর্টকাট হাঁটার রাস্তা আছে। এখান থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরো অসাধারণ। এরপর আবার প্রায় ১৭ কিলোমিটার ফিরে এসে আরেকটি মনেস্ট্রি দর্শন করতে পারে যেটির নাম লিখাঙ্গ মনিস্ট্রি।
এরপরে দিন আপনি তিনভং গ্রামে থাকতে পারেন। এখান থেকে লিংথেম হট স্প্রিং, এখান থেকে আরো দু’ঘণ্টা হাঁটা পথে পৌঁছে যাবেন একটি সুন্দর কেভ পয়েন্ট। এখানে আসার জন্য আপনাকে একটি গাইড নিতে হবে, যা আপনি এই হট স্প্রিং থেকে পেয়ে যাবেন। পাহাড় এবং জঙ্গলের মাঝে একটি খুব সুন্দর গুহা। এরপর চলে আসুন তিনভংয়ে আপনার থাকার জায়গা। আপনি এখানে কয়েক দিন থাকতে পারেন । জঙ্গু এমন একটি জায়গা যেখানে আপনি ধান ক্ষেতের পাশাপাশি চা বাগান দেখতে পাবেন। সংমিশ্রণটি খুবই দুর্দান্ত। এখানে লোকাল খাবারগুলোর মধ্যে ফালে অবশ্যই খেয়ে দেখবেন, খাবারটি বেশ সুস্বাদু ছিল। পরদিন সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সকালের খাবার খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম ঘুরে দেখতে। এইসব অফবিট গ্রামে বাইক নিয়ে ঘুরার অভিজ্ঞতা অসাধারণ। পরের দিন বাড়ি ফিরতে মনটা বেশ খারাপই হয়ে গিয়েছিল কারণ এখানে মানুষের আপ্যায়ন এবং তাদের জীবনের সরলতার আর প্রকৃতির এই সুন্দর্য আপনাকে বারবার এখানে আসতে বাধ্য করবে।