কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের জন্য অনেকেই থাইল্যান্ডকে বেছে নেন। জানেন সে দেশে কোন ট্যুরিজ়ম সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়? এলিফ্যান্ট ট্যুরিজ়ম। সাদা হাতির দেশ থাইল্যান্ড। বিদেশি পর্যটকদের ভিড় সেখানে সারা বছর লেগেই থাকে। আর সেখানেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এলিফ্যান্ট ট্যুরিজ়ম। অর্থাৎ হাতির পিঠে থাইল্যান্ড ঘোরা। কিন্তু সে দেশের হাতিরা কেমন আছে, খবর রাখি ক’জন?
অনেকেই হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ায় থাইল্যান্ডের ভাইরাল হওয়া হাতির ছবি দেখেছেন। টানা ২৫ বছর ধরে একপ্রকার ‘পাবলিক সার্ভিস’ দেওয়ার পর এক হস্তিনীর পিঠ ঝুঁকে গিয়েছে। মাঝখান থেকে ভেঙে গিয়েছে তার শরীর। কোনও রকমে টিকে রয়েছে তার মেরুদণ্ড। হস্তিনীর নাম পাই লিন। এখন তার বাড়ি থাইল্যান্ডের ওয়াল্ডলাইফ ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশনে। সেখানে পাই লিন-এর মতো এমন ভগ্নপ্রায় অবস্থা আরও অনেক হাতির।
ওয়াল্ডলাইফ ফ্রেন্ডস ফাউন্ডেশন থাইল্যান্ড (ডব্লিউএফএফটি) একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে তৈরি করা ছোট্ট অভয়ারণ্য। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্কক থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা দূরত্বে সমুদ্র-উপকূলবর্তী হুয়া হিন শহরের বুকে অবস্থিত এই অভয়ারণ্য। এই অভয়ারণ্যের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক হলেন এডউইন উইয়েক। ৮৫০টিরও বেশি বন্যপ্রাণীকে উদ্ধার করে এই অভয়ারণ্যে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ২৯টি হাতি। অনুদানের মাধ্যমেই এই অভয়ারণ্যটি এখনও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
পাই লিনের এমন ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন ডব্লিউএফএফটি। যেহেতু থাইল্যান্ডে এলিফ্যান্ট ট্যুরিজ়ম পর্যটন শিল্পের এক বড় অংশ, তাই পাই লিনের মতো কয়েক শো হাতি প্রতিদিন কাজ করে পর্যটক বয়ে বেড়ানোর। এই পাই লিনকেই প্রায় আড়াই দশক ‘চাকরি’ করতে হয়েছে থাইল্যান্ড ট্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিতে। এলিফ্যান্ট ট্যুরিজ়মের অঙ্গ হিসেবে একসঙ্গে প্রায় ৬ জন যাত্রীকে হাতির পিঠে বসানো হয়। তার সঙ্গে আসনের ভার রয়েছে। যেমন কাজ তেমন পুষ্টি বা বিশ্রাম মেলে না হাতিদের। যার জেরে পাইন লিনের মতো হাতিদের আজ এই দুরবস্থা। শেষ বয়সে এসে তাদের যত্নের দায়িত্ব নিয়েছে ডব্লিউএফএফটি।
এডউইন উইয়েক সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ২০০৬ সালে এই অভয়ারণ্যে নিয়ে আসা হয় পাই লিনকে। দুর্বল হওয়ার কারণে ২০০৪ সালে এই হস্তিনীকে বিক্রি করে দেয় পাই লিনের মালিক। দক্ষিণ থাইল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি এই এলিফ্যান্ট ট্যুরিজ়ম জনপ্রিয়। ন্যাশানাল জিওগ্র্যাফিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এডউইন জানিয়েছেন, যখন তিনি এইসব পর্যটন কেন্দ্রে যান, সেখানখার হাতিদের অবস্থা দেখে তাঁর করুণা হয়। হাতিদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা দেখে মনে হয় এদের এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। কিন্তু পর্যটকেরা দেড় হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ করতে রাজি এই সব হাতির পিঠে চড়ার জন্য।
এত গেল থাইল্যান্ডের হাতির গল্প। ভারতীয় হাতিদের কীরূপ অবস্থা জানেন? অস্কারজয়ী ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’ সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বে। তামিলনাড়ুর মুদুমালাই জাতীয় উদ্যানে শুটিং হয়েছে গোটা তথ্যচিত্র। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের হাতিরা মোটেও সুখে নেই। কেরলের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র মুন্নার। সেখানে রয়েছে ক্যারমেলাগিরি এলিফ্যান্ট পার্ক। সেখানে সহজেই হাতির পিঠে চড়তে-চড়তে পশ্চিমঘাটের সফর করা যায়। একই অবস্থায় পেরিয়ারেও। থেক্কাডির এলিফ্যান্ট ক্যাম্পেও একই ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত।
ভারতে ২,৬৭৫ হাতি আজ রয়েছে ‘পরাধীনতা’য়। তাদের মধ্যে কারও মালিক রয়েছে, কেউ যুক্ত রয়েছে পর্যটন শিল্পে। আবার কাউকে ব্যবহার করা হয়েছে ধর্মীয় বা অন্য উদ্দেশে। হাতিরাও কিন্তু পাল্টা আক্রমণ করে। দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার সহ্য করতে-করতে তারাও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কেরলে প্রায় ৫০টি এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে হাতিরা তাদের মালিক, মাহুতের উপর হামলা করেছে।
ভারতের হাতির পরিস্থিতি খুব একটা ভাল নয়। ভারতের বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন ২০২২-এর সংশোধন এখন হাতিকে ধর্মীয় বা অন্য কোনও উদ্দেশে ব্যবহার করা বা বন্য হাতি নিয়ে ব্যবসা করা আরও সহজ করে দিয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কিংবা রেললাইনে কাটা পড়ে হাতির মৃত্যুর ঘটনা এদেশে কম নয়। প্রতি বছর কমপক্ষে ৫০টি হাতির মৃত্যু হয় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। সুতরাং, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পাই লিনের মতো ভারতেও রয়েছে। আর সব হাতির ভাগ্য ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’-এর ‘রঘু’র মতো হয় না, কারণ বাস্তবের পৃথিবীতে ‘রঘু’দের জন্য চোখের জল ফেলা ‘অম্মু’র সংখ্যা নিতান্তই কম। সেইসব ‘এলিফ্যান্ট’দের ‘হুইস্পার’ বা ফিশফিশ যে পৌঁছয় না কারও কানেই।