‘রামপুরী চাকু’—শব্দ দু’টো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই চোকের সামনে ভেসে ওঠে বলিউডের কিছু দৃশ্য। সত্তর-আশির দশক। বলিউডে রাজ করছে খলনায়কেরা। নায়কের পাশাপাশি তখন ‘এক সে বড় কর এক’ খলনায়কেরও রমরমা। নায়ককে মারতে কোমর থেকে ভিলেন বের করল শান-দেওয়া, চকচকে রামপুরী চাকু। ‘ইয়ে বচ্চোঁ কে খেলনে কি চিজ় নেহি হ্যায়’—১৯৬৫ সালের সুপার-ডুপারহিট বলিউডি ছবি ‘ওয়াক্ত’ (Waqt)-এ মদন পুরি যখন এই ধারাল, ফোল্ডিং ছুরি বের করে, তখন নায়কোচিত কেতায় তা ভিলেনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন রাজকুমার। এই রামপুরী চাকুর এক কোপেই কেটে যেতে পারত নায়কের গলা। বলিউডের সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে আমজনতার মধ্যেও পরিচিতি পেতে শুরু করল এই রামপুরী চাকু। তারপর বলিউডেও এল অন্য ট্রেন্ড। সময়ের সঙ্গে ফিকে হতে শুরু করল রামপুরী চাকুর ধার। তবে, পুরনো দিনের হিন্দি সিনেমা দেখলেই এই রামপুরী চাকুর দেখা পাওয়া যাবে। এই ছুরির অস্তিত্ব যাতে পুরোপুরি হারিয়ে না যায়, তার জন্য রামপুরী চাকুর স্থাপত্য নির্মাণ করেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার।
প্রসঙ্গত, উত্তরপ্রদেশের রামপুর জেলায় জন্ম এই রামপুরী চাকুর। জায়গার নাম অনুযায়ী রাখা হয়েছিল ছুরির নাম। যখন বলিউড থেকে আমজনতার মধ্যে এই রামপুরী চাকুর রমরমা ছিল, তখন রামপুরের আনাচেকানাচে তৈরি হত এই ছুরি। রামপুরের বহু কারখানায় এই ফোল্ডিং ছুরি তৈরি করার কাজ চলত। জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কারখানাগুলোও এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে, যে ছুরির জন্য আজ রামপুর সারা দেশে জনপ্রিয় এবং যে ছুরির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্য, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে তো হবেই। তাই রামপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ২০ ফুটের একটি ধাতব রামপুর ছুরির স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রায় ১২৫ বছর আগে রামপুরের নবাব মুহাম্মাদ মুস্তাক আলি খান তাঁর এলাকার কামার উস্তাদ বেচ খানকে এক ধরনের ইতালীয় ছুরি দেখান এবং তার প্রতীকী বানিয়ে দিতে বলেন। উস্তাদ নবাবকে বলেন, তিনি এর চেয়ে ভাল ছুরি বানিয়ে দিতে পারেন। আর তারপরই জন্ম হয় রামপুরী চাকুর। আশির দশকে প্রায় গোটা রামপুর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল শুধু এই ছুরি তৈরি করতে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে রামপুরে অসংখ্য ছোট-ছোট কারখানা গড়ে উঠেছিল, যেখানে এই ছুরি তৈরি হত। সেই সময় কারিগরদের প্রায় ৪০০ লাইসেন্স জারি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় এই ছুরিকে দেখা হত একটু অন্য চোখে। বলিউডে চোর, পকেটমার, অপরাধীদের হাতেই রামপুরী চাকু দেখানো হয়েছিল। তাই অপরাধমূলক কাজের সঙ্গেই নাম জড়িয়ে গিয়েছিল রামপুরী চাকুর। তবে, আমজনতারা এই ছুরির খোঁজেই রামপুর আসত। তারপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ছুরির উপর। রামপুরের চাকু বাজারে আগে শ’য়ে শ’য়ে দোকান ছিল, এখন সেটা এসে ঠিকেছে দু’টোয়।
একটা সময় এমন এসেছিল, যখন রামপুর রেল স্টেশনে নেমেই মানুষ ছুরির খোঁজ করত এই বলিউড-খ্যাত ছুরির। মূল বাজার ছাড়াও বাস স্টপ ও স্টেশন চত্বরের দোকানেও থরে-থরে বিক্রি হত রামপুরী চাকু। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসতেন ছুরির খোঁজে। কারণ রামপুর ছাড়া এই ছুরি দেশের অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। রামপুরী চাকুর জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে, তখন ধীরে-ধীরে বাজারে আসে চিনের তৈরি ছুরি। অর্ধেক দামে মিলতে শুরু করল চিনা ‘রামপুরী চাকু’। দাম কম ঠিকই, কিন্তু আসল রামপুর চাকুর পাশে তার মান অত্যন্ত নিম্ন। কিন্তু যেহেতু সস্তায় ও সহজেই ‘মেড ইন চায়না’ ফ্লোডিং ছুরি পাওয়া যেতে শুরু হল, তাই ধীরে-ধীরে আসল রামপুরী চাকুর ব্যবহার কমতে বসল। আর গত এক দশকে কার্যত বিলুপ্তির পথে রামপুরী চাকু।
এই ছুরির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ২৮ বছর পর স্থানীয় প্রশাসন তৈরি করল রামপুরী চাকু। স্থাপত্যের নীচে লেখা ‘World’s Largest Dagger’ অর্থাৎ ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছুরি’। জিম করবেট ন্যাশানাল পার্ক, নৈনিতাল যাওয়ার পথে উত্তরপ্রদেশের এই রামপুর শহরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। উত্তরাখণ্ড থেকে নৈনিতাল রোড ধরে রামপুর যাওয়ার সময়ই চোখে পড়বে এই ২০ ফুট উচ্চ রামপুরী চাকু। এই স্থাপত্য নির্মাণ করতে প্রায় ৫৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এবার দিল্লি হয়ে নৈনিতাল যাওয়ার পথে আপনি সহজেই দেখতে পারেন রামপুরী চাকুর এই স্থাপত্য।