
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাস পড়েননি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘কপালকুণ্ডলা’। এই উপন্যাসের স্থান-কাল-পাত্র সব কিন্তু কাল্পনিক ছিল না। সেটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় কাঁথির দরিয়াপুর গ্রামে গেলে। সেখানেই রয়েছে ঐতিহাসিক কপালকুণ্ডলা মন্দির। উপন্যাসের ভাবনার বীজ লুকিয়ে রয়েছে রোপণ হয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির কপালকুণ্ডলা মন্দিরে। এবার এই কপালকুণ্ডলা মন্দির দ্রুত যুক্ত হতে চলেছে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে। এই পদক্ষেপ নিয়েছেন হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঐতিহাসিক কপালকুণ্ডলা মন্দির এবং জাতীয় সড়ক থেকে দরিয়াপুর গ্রামে যাওয়ার রাস্তা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। মন্দির থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে পেটুয়াঘাট লাইট হাউস ও মৎস্যবন্দর। সেখানে তৈরি হয়েছে মেরিন ড্রাইভ। নতুন পর্যটন মানচিত্রে সেই মেরিন ড্রাইভও যুক্ত হতে চলেছে। দিঘা থেকে মন্দারমণি হয়েছে কাঁথির সৌলা হয়ে জনপুট পর্যন্ত চালু হয়েছে এই মেরিন ড্রাইভ। পাশাপাশি সাজিয়ে তোলা হয়েছে দিঘা ও সংলগ্ন সমুদ্র সৈকত। বাকি ১৬ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ চালু হয়ে গেলে দিঘা কিংবা মন্দারমণি থেকে সরাসরি পৌঁছে যেতে পারবেন কপালকুণ্ডলা মন্দির। এই সমগ্র সার্টিক রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে যুক্ত করার পরিকল্পনা চলছে।
শোনা যায়, আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে কপালকুণ্ডলা নামে এক নারীর হাত কেটে বলি দিচ্ছিলেন এক কাপালিক। সেই সময় কপালকুণ্ডলাকে উদ্ধার করেন এক যুবক। সেই থেকে এই মন্দিরের নাম হয় কপালকুণ্ডলা এবং এখানে কালীপুজোর প্রচলন শুরু হয়। অন্যদিকে, ১৮৬০-এর দশকে মেদিনীপুরের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র আসেন এই দরিয়াপুর গ্রামে। মন্দিরের সামনের এক বাড়িতেই তিনি থাকতেন। আর সেখানে থাকতেন ওই কাপালিক ও কপালকুণ্ডলা। সেই সময় কাছেই দিল সাগরদ্বীপ। সে সময় বঙ্কিমচন্দ্রকে সমুদ্র মোহনার হোমযজ্ঞের জন্য প্রচোরিত করে ওই কাপালিক। তিনি যাতে সেখানে না যান সেজন্য তাঁকে সাবধান করতে আসতেন সাদা বস্ত্র পরা এক মহিলা, যাঁর পরিচয় জানা যায় না। এরপরই তৈরি হয় ‘কপালকুণ্ডলা’।
গল্প যা-ই হোক না কেন, এই ঐতিহাসিক মন্দির দেখতে প্রচুর মানুষ ভিড় করেন। গা-ছমছম পরিবেশ, ঘন জঙ্গল ও গাছপালায় ভর্তি মন্দির চত্বর। চুন-সুরকি আর ইটের গাঁথুনিতে তৈরি প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো চণ্ডীমন্দির। এমন পরিবেশ দাঁড়িয়ে উপন্যাসের কিছু দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মন্দির মূর্তিহীন। ২০০৫ সালের ২ ডিসেম্বর এই মন্দিরকে হেরিটেজের তকমা দেয় রাজ্য সরকার। তবে সংস্কারের কাজ সেভাবে শুরু হয়েছিল না। ২০১১ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই মন্দির সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। তখন সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল কালী মূর্তি। ২০১৩ সালে মন্দির সংস্কারের কাজ শেষ হলেও মন্দিরে কালী মূর্তি ফিরে আসেনি। সংস্কারের পরও ধীরে-ধীরে ক্ষয়ে যেতে শুরু করে মন্দির। তবু জনপ্রিয়তা কমেনি। তাই ভাবনা চলছে এই মন্দিরকে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে যুক্ত করার।