
জীবনের ৬৯টা বসন্ত পার করে দিলেন কিংবদন্তী গায়ক-কম্পোজার বাপ্পি লাহিড়ী। বাপ্পিদা মানেই কি শুধুই ডিস্কো কিং আর ঝলমলে গয়না। না, তাঁর জীবন রঙিন, রয়েছে সংগ্রামও। তিন বছর বয়সেই তবলা শেখা। ইচ্ছে ছিল মুম্বইয়ে পাড়ি দেওয়ার। তারপর কী হল? জন্মদিনে চেনা মানুষকে চিনে নেওয়া খানিক অন্যভাবে...।

তাঁর আসল নাম অলোকেশ লাহিড়ি। জন্ম জলপাইগুড়ি জেলা ১৯৫২ সালে। ডাক নাম ছিল বাপি। রেখেছিলেন এক আত্মীয়া। কে জানত, একদিন এই নামেই বিশ্ব কাঁপাবেন তিনি। বাড়িতে সঙ্গীতের চর্চা ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। বাবা অপরেশ লাহিড়ি আর মা বাঁশুড়ি লাহিড়ী দুজনেই বাংলা সঙ্গীত জগতে ছিলেন পরিচিত নাম। গানের হাতেখড়ি পরিবারেই।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে মুম্বই পাড়ি দেন গায়ক। ইচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া, চোখে সোনালি স্বপ্ন। ১৯৭৩ সালে হিন্দী ভাষায় নির্মিত নানহা শিকারী ছবিতে তিনি প্রথম গান রচনা করেন তিনি। এরপর তাহির হুসেনের জখমী (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে কাজ করেন।

মাত্র ১১ বছর বয়সে নাকি প্রথম গানের সুর দিয়েছিলেন তিনি। অসম্ভব দ্রুতগতিতে সব কিছু ধরে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর। বাংলা ছবি দাদুতে ১৯৭২ সালে সুর দেন। কিন্তু মন টেঁকেনি শহরে। মায়ানগরীর হাতছানি দিচ্ছিল তাঁকে। ছেলের কারণে, বাবা-মাও শিফট হয়ে গিয়েছিলেন বম্বেতে।

কথায় বলে বাঙালি নাকি কাঁকড়ার জাত। সত্যি কি তাই? বাপ্পিকে মুম্বইয়ে প্রথম ব্রেক কিন্তু দিয়েছিলেন এক বাঙালি পরিচালকই। তিনি শমু মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের শুরুতে নানহা শিকারির কথা বলছিলাম, এই নানহা শিকারির পরিচালক ছিলেন তিনিই। শমু আবার সম্পর্কে কাজলের বাবা, তনুজার স্বামী।

সাল ১৯৭৪। সে সময় রাহুল দেব বর্মণ ভীষণ ব্যস্ত। তাঁর ডেট পাওয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রযোজকদের কাছে। প্রযোজক হুসেনের ছবি মদহোসে গানের সুর দিলেন আর ডি বর্মণ। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করার সময় ছিল না তাঁর কাছে। অফার যায় বাপ্পি লাহিড়ীর কাছে। তিনি তখন একেবারে আনকোরা।

বাপ্পির রাজিই ছিলেন কিন্তু বাধ সাধেন বাবা অপরেশ লাহিড়ী। প্রযোজক তাহির হুসেনকে তিনি বলেন, আর ডি বর্মনের সুর দেওয়া ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তাঁর ছেলে করতে পারেন তবে এক শর্ত রয়েছে, আর ডি'র কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হবে সবার আগে। ভবিষ্যতে যাতে এই নিয়ে কোনও কথা না ওঠে সেই কারণেই হয়তো এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

তাই হয় ... ১৯৭৫-এ বাপ্পি পেয়ে যান জাখমি ছবির ব্রেক। বাপ্পির হিট হিসেবে প্রথম জাখমিকেই ধরা যেতে পারে। ওই ছবিরও প্রযোজক ছিলেন তাহির হুসেন। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুনীল দত্ত, আশা পারেখ, রাকেশ রোশন, রীনা রায় সহ অনেকে। পরিচালনায় ছিলেন রাজা ঠাকুর। কিশোর কুমারের হাস্কি গলায় জালতা হ্যায় জিয়া মেরে অথবা লতার গলায় বাপ্পির সুরে আভি আভি থি দুশমানি... আজও কি ভোলা যায়?

তাঁকে ডিস্কো কিং বললে ভুল বলা হবে। রোম্যান্টিক গান থেকে শুরু করে ভজন, কাওয়ালি থেকে রাগাশ্রয়ী গান, সবেতেই ছিল তাঁর অনায়াস যাতায়াত। টুটে খিলানে ছবিতে নানহা সা পঞ্চি মেরা -- সর্বক্ষেত্রেই ছিল তাঁর অনায়াস যাতায়াত।

১৯৮৬ সালে গিনিশ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম তুলে নিয়েছিলেন। ৩৩টি ছবির জন্য ১৮০টি গান রেকর্ড করে। তিনিই একমাত্র ভারতীয় মিউজিক ডিরেক্টর যিনি জোনাথন রসের লাইভ পারফরম্যান্সে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ১৯৮৯ সালে। তাঁর আইকনিক গান জিমি জিমি আজা আজা... হলিউড ছবি ' You Don't Mess With The Zohan's'-এ ব্যবহার করা হয়েছিল।

কালো চশমা আর গলায় বেশ কয়েক ভরি সোনার হার, কেন সবসময় সোনার হার পরে থাকেন বাপ্পি লাহিড়ি? এ প্রশ্ন বহুজনের। উত্তর দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। বলেছিলেন, প্রথম সোনার চেন উপহার দিয়েছিলেন মা, এর পর স্ত্রী তাঁকে গণেশের লকেট দেওয়া এক চেন উপহার দেন। তিনি মনে করেন, সোনা তাঁর জন্য বেশ লাকি। আর সে কারণেই সোনা পরে থাকার সিদ্ধান্ত তাঁর।

সম্প্রতি রটে তাঁর স্বর হারানোর খবর। তবে সে খবরকে নস্যাৎ করে কিছুদিন আগে এক রিয়ালিটি শো-য়ে এসেছিলেন তিনি। পুজোর সময়েও গান রিলিজ হয়েছে তাঁর। তিনি ভাল থাকুন। তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।