উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চোরাবাড়ি হিমবাহের কাছে, মন্দাকিনী নদীর তীরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৫৮৩ মিটার উপরে অবস্থিত দেশের বিখ্যাত ও হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ মন্দির, কেদারনাথ মন্দির (Kedarnath Temple)। ভারতের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের (Jyotirlinga) মধ্যে এটি একটি অন্য়তম। যার উল্লেখ মহাভারতেও রয়েছে। উল্লেখ্য, কেদারনাথ মন্দির হল ভগবান শিবের (Lord Shiva) পবিত্র ধাম, উত্তরাখণ্ড চারধাম যাত্রার অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই মন্দিরটি এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যেখানে চরম ঠান্ডার কারণে বছরে ৬ মাস মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। ভাইফোঁটা, দীপাবলির সময় মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর এপ্রিলের শেষের দিকে বা মে মাসের শুরুতে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ফের ভক্তদের জন্য মন্দির খুলে দেওয়া হয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ মন্দির দর্শনের জন্য় দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী ও পর্যটক ভিড় করেন। প্রবল ঠান্ডার জন্য় কেদারনাথের অধিষ্ঠিত দেবতাকে উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার উখিমঠে নিয়ে যাওয়া হয়। কেদারনাথ মন্দির না খোলা পর্যন্ত সেখানেই পুরোহিচরা পরবর্তী ৬ মাস পুজো করেন। চলতি বছরের, গত ৬ মে থেকে কেদারনাথ মন্দির খুলে দেওয়া হয়েছে। চারধামযাত্রায় অন্য়তম অংশ হিসেবে এখানেও প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়েছে। তবে এবার রেকর্ড ভিড়ের কারণে বেসামাল হয়ে পড়েছে প্রশাসন। এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র কেদারনাথেই মৃত্যু হয়েছে ৪০জনের বেশি। মন্দির যত প্রাচীন হয়, ততই সেই মন্দির নিয়ে রহস্য দানা বাঁধতে থাকে। কেদারনাথ মন্দির শুধু হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ মন্দির নয়, এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু পৌরাণিক কাহিনি ও অজানা রহস্য।
১. গুপ্ত যুগের শিলালিপিতে এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। তারপর এগারো শতকে গর্ভগৃহ সমেত গোটা মন্দিরের নির্মান হয়। পরবর্তীতে বারো শতকে মন্দির সংস্কার করা হয়। পুরাণ মতে জানা যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মহাভারতে জ্ঞাতি হত্যার পাপ থেকে মুক্তি পেতে পান্ডবগন তীর্থ দর্শন করতে বেরিয়ে পৌঁছেছিলেন। সেই সময় তারা কাশীতে এসে জানতে পারেন ভগবান শিব তাঁদের দর্শন না দেওয়ার জন্য পাহাড়ের কোলে আত্মগোপন করেছেন। সেখানে নাকি তিনি এক ষাঁড়ের ছদ্মবেশে লুকিয়ে রয়েছেন। খুঁজতে খুঁজতে তারা গৌরিকুণ্ডের কাছে সেই ষাঁড়কে মাটিতে মিশে যেতে দেখে ভীম জাপটে ধরেন। ভগবান তাঁদের হাত থেকে নিস্তার পেতে দৌর শুরু করলেন। এইভাবে দীর্ঘক্ষণ সময় পেরিয়ে মাটি ভেদ করে উপরে উঠে আসলেন বৃষরূপী মহাদেব। তাই কেদারনাথে বৃষের পিঠের কুজ জ্যোতিরলিং হিসাবেই পূজা করা হয়।
২. মহাভারত অনুসারে জানা যায়, একদা পাণ্ডবরা ভগবান শিবকে তুষ্ট করার জন্য কেদারনাথ মন্দির নির্মাণ করেন। শোনা যায়, ৮ম শতকে হিন্দু দার্শনিক আদি শঙ্করাচার্য তাঁর শিষ্যদের নিয়ে এই মন্দির দর্শনে এসেছিলেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো – ২০১৩ সালে বিধ্বংসী বন্যায় কেদারনাথ শহরের প্রচুর ক্ষতি হলেও মন্দিরের কোনও রকম ক্ষতি হয়নি।
৩. শিব বেশধারী ষাঁড় ভীমের গদার আঘাতে মোট পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত হন । কেদারনাথ ছাড়াও বাকী শিবলিঙ্গ গুলি হল – তুঙ্গনাথ, রুন্দ্রনাথ, মদমহেশ্বর, কল্পেশ্বর, যা পঞ্চকেদার নামেও পরিচিত। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল কেদারখণ্ড; তাই এখানে শিবকে কেদারনাথ (অর্থাৎ, কেদারখণ্ডের অধিপতি) নামে পূজা করা হয়।
৪. যে কোনও দুর্যোগ বা ধ্বংসলীলায় মন্দির সুরক্ষিত এবং অবিনশ্বর। ২০১৩ সালে বিধ্বংসী হরপা বানে কেদারনাথ মন্দির-সহ শহরের প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। পার্বত্য অঞ্চলে বিধ্বংসী ভূমিধস এবং বন্যার শিকার হলেও, পাহাড় থেকে নেমে আসা বিশাল পাথর নেমে আসা সত্ত্বেও মন্দিরটির কোনও রকম ক্ষতি হয়নি। অনেকেই মনে করেন, কোনও এক ঐশ্বরিক শক্তি এটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, একটি বিশাল পাথর মন্দিরের পিছনের অংশকে আটকে রেখেছিল। যার কারণেই জল এবং ধ্বংসাবশেষ তাদের গতিপথ পরিবর্তন করেছিল এবং কেদারনাথ মন্দির ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা হয়েছিল।
৪. মন্দিরের অভিভাবক হলেন ভগবান ভৈরননাথজী। হিমালয়ের প্রকৃতির কোলে অবস্থিত কেদারনাথ মন্দিরটি নাকি তিনিই পাহারা দেন। ভগবান ভৈরনাথ জি গাড়োয়াল অঞ্চলের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবতা । তিনি সুরক্ষা এবং ন্যায় বিচারের প্রভু। ভগবান শিবের জ্বলন্ত অবতার এবং ধ্বংসের সাথে যুক্ত। ভৈরনাথজি “ক্ষেত্রপাল” নামেও পরিচিত। ভৈরনাথজির মন্দির কেদারনাথ মন্দিরের দক্ষিনে অবস্থিত। কেদারনাথ মন্দিরকে খারাপ আত্মা বা শক্তি থেকে রক্ষা করে থাকেন।
৫. কেদারনাথ মন্দির পঞ্চ কেদার এর একটি অংশ। পঞ্চ কেদার ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত পাঁচটি পবিত্র স্থান। যার সবকটি গাড়োয়াল হিমালয় এ অবস্থিত। শুধু তাই নয়, যারা পঞ্চকেদার তীর্থযাত্রায় পড়ে -তুঙ্গনাথ (যেখানে ভগবান শিবের হাত পড়েছিল), রুদ্রনাথ ( যেখানে ভগবান শিবের মুখ পড়েছিল), মধ্য মহেশ্বর (যেখানে ভগবান শিবের পেট পড়েছিল), এবং কল্পেশ্বর (যেখানে ভগবান শিবের নীচের অংশ পড়েছিল)।
৬. কেদারনাথ তীর্থ পুরোহিতদের কেদারনাথের পান্ডা বা তীর্থ গুরু বলা হয়। আদতে কর্ণাটকের পুরোহিতরা এখানে কন্নড় ভাষায় পূজা পরিচালনা করেন। দারনাথ মন্দিরের হিন্দুদের উপাসনালয়ের উত্তর-দক্ষিণ ঐক্যের একটি চমকপ্রদ নিদর্শন। কর্ণাটকের বীর শৈব সঙ্গম সম্প্রদায়ের অন্তর্গত রাওয়াল সম্প্রদায়ের সদস্যদের দ্বারা আচার অনুষ্ঠান করা হয়।খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে, এখানে পুজো কন্নড় ভাষায় এবং একই রীতিতে পালন করা হয়ে থাকে। রাওয়াল বা প্রধান পুরোহিত মন্দিরের অভ্যন্তরে আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন না বরং তার সহকারীকে এই দায়িত্ব অর্পণ করেন। শীতকালে যখন দেবতা উখিমঠে স্থানান্তরিত হয়, তখন রাওয়াল প্রধান দেবতার সঙ্গে অবস্থান স্থানান্তর করেন। কেদারনাথের তীর্থ পুরোহিত অর্থাৎ পান্ডারা কেদারনাথ উপত্যাকায় প্রধানত তিনটি নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করেন। যেগুলি হল- গুপ্তকাশীর বামসু এলাকা, গুপ্তকাশীর উত্তর এলাকা, উখিমঠ। কেদারনাথ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রাওয়াল বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।