বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যুষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। বিশেষত শিক্ষার্থীদের জন্যে সরস্বতী পুজো খুবই স্পেশাল। সকাল থেকেই উপোস থেকে বাগদেবীর উদ্দেশ্যে অঞ্জলি দেন তারা। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞানের প্রার্থনা করেন বাগদেবীর কাছে। পুরোহিত ছাড়াও বাগদেবীর আরাধনায় নিজেই প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। কেমনভাবে তা সম্ভব? জেনে নিন…
পুজোর উপাদান
সরস্বতী দেবীর মূর্তি, সাদা কাপড়, ফুল(পলাশ ফুল), আম্রপত্র, বেলপাতা,কাঁচা হলুদ, সিঁদুর, চাল, ধান, দূর্বা, ফল পাঁচ ধরনের(কলা এবং নারকেল আবশ্যক), কলস, সুপুরি, পানপাতা, ধুপকাঠি, প্রদীপ, দুধ, খাগের কলম এবং দোয়াত।
সকালের নিয়ম
সরস্বতী পুজোর দিন সকাল বেলা উঠে স্নান করার নিয়ম। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য সকালে স্নান করা আবশ্যক। স্নানের জলে নিমপাতা ও তুলসী পাতা দেওয়ার নিয়ম আছে। এতে জলের শুদ্ধিকরণ ঘটে। এছাড়া স্নান করার আগে মুখে এবং গায়ে নিম ও কাঁচা হলুদ বাটা মাখতে হয়। এতে আমাদের দেহের শুদ্ধিকরণ ঘটে এবং শরীরের কোনো রকম ইনফেকশন থেকেও এই মিশ্রণ রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। স্নান করার পর যে পুজো করবে তাকে সাদা বা হলুদ বস্ত্র পরিধান করতে হয়।
মূর্তি এবং কলস স্থাপন
প্রথমে পুজোর জায়গাটি ভালো করে পরিষ্কার করে মুছে নিয়ে একটি ছোট জলচৌকি বসাতে হবে।তবে এটি আবশ্যক নয়। এরপর একটি পরিষ্কার সাদা কাপড় পেতে দিতে হবে তার ওপর। এবার দেবী সরস্বতীর মূর্তিটি এর ওপর স্থাপন করতে হবে।দেবী মূর্তিকে ফুলের মালা পরিয়ে সুসজ্জিত করে এবং পুজোর স্থানে ভালো করে হলুদ, সিঁদুর এবং চাল দিয়ে আলপনা দিতে হবে। এছাড়া স্থানটি ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে। বই, খাতা, পেন, পেন্সিল এবং হারমোনিয়াম ঠাকুরের মূর্তিটির পাশে রাখতে হবে, এবং সেখানেও ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে। কালির দোয়াতগুলি দুধ দ্বারা পূর্ণ করতে হবে এবং তাতে খাগের কলমগুলি রাখতে হবে। এই কালির দোয়াতগুলি ঠাকুরের মূর্তির সামনেই রাখতে হবে। এবার কলস বা ঘট জল পূর্ণ করে তাতে প্রথমে আমের পল্লব রাখতে হবে।তার ওপর পানপত্র রেখে একটি সুপুরি রাখতে হবে। এর ওপর ফুল ও দূর্বা রাখতে হবে। দেবী মূর্তির পাশে একটি গণেশ ঠাকুরের মূর্তি রাখতে হবে।
পূজারম্ভ
প্রথমে ফুল ও বেলপাতা নিয়ে গণেশ ঠাকুরের চরণে তা অর্পণ করে পূজারম্ভ করতে হবে। তারপর একই ভাবে ফুল ও বেলপাতা একে একে বাগদেবীর চরণে অর্পণ করে পুজো আরম্ভ করতে হবে।এর সাথে দেবীকে আরাধনার মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে। এই মন্ত্রগুলির জন্য নির্দিষ্ট বই আছে যেখানে পুজোর সমস্ত নিয়ম আপনি জানতে পারবেন। এর পর ধুপ ও দীপ জেলে ফল, মিষ্টি ও নৈবিদ্য অর্পণ করে এবং সব শেষে পুষ্পাঞ্জলি দিতে হবে।
শ্রীপঞ্চমী পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রঃ
ওঁ জয় জয় দেবী চরাচরসারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।।
ওঁ সরস্বত্যৈ নমা নিত্যং ভদ্রকাল্যৈ নমা নমঃ বেদবেদান্তবেদাঙ্গ বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।
এষ সচন্দন পুষ্পবিল্বপত্ৰাঞ্জলি সরস্বত্যৈ নমঃ ॥ ( এই মন্ত্রে তিনবার অঞ্জলি দেওয়াবেন।)
পুজো শেষ করে তবেই কিন্তু জল এবং খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। আর ঐদিন কিন্তু পড়াশোনা একদম বন্ধ। আর প্রসাদ হিসেবে ওই দিনের খাবার কিন্তু ফল, খই, মুড়কি, মিষ্টি, খিচুড়ি, লাবড়া ইত্যাদি। পুজোর বাকি মন্ত্রের জন্য কিন্তু প্রয়োজন হবে পুজোর পাঁচালি, যা আপনি সহজেই পেয়ে যাবেন।
দ্বিতীয় দিনের পুষ্পাঞ্জলি ও দধিকর্মা
পুজোর পরের দিন সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে পুজোয় ব্যবহৃত বেলপাতায় খাগের কলমগুলি দুধে চুবিয়ে ‘ওম সরস্ব্ত্যই নমঃ’ লিখতে হবে তিনবার। তারপর ফুল ও বেলপাতা সমেত পুষ্পাঞ্জলি দিতে হবে। এর পর ঠাকুরের নৈবিদ্যের খই,দই এবং মিষ্টি দ্বারা গোল মন্ডের মত আকারের প্রস্তুত করতে হবে একটি প্রসাদ যা অত্যন্ত উপাদেয় এবং এই প্রসাদ খাওয়ার জন্য কিন্তু বাড়ির ছোট বড় সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। একে দধিকর্মা বলা হয়। এরপর বই খাতাগুলি সরিয়ে নেওয়া যায়। পুজোর ফুল বেলপাতা সাধারণত আমরা বইয়ের পাতায় রেখে থাকি আশীর্বাদ স্বরূপ। এরপর কিন্তু দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে দেবী মূর্তিটিকে বিসর্জন দেওয়া হয়ে থাকে। দেবী মূর্তি সাধারণত সন্ধ্যেবেলায় বিসর্জন দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: Saraswati Puja 2022: বাগদেবীর আরাধনার শুভতিথি কখন? বাড়িতে পুজো করলে কী মন্ত্র পড়বেন, জানুন