
জন্মাষ্টমীর মাহাত্ম্য এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কারণ এই বিশেষ দিনে সন্তানসুখ থেকে ঘরে সুখ-সমৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য প্রায় সকলেই ছোট্ট গোপাল-ঠাকুরের পুজো করে থাকেন। আর জন্মাষ্টমীর দিন অত্যন্ত ধুমধাম করে পুজো করার চল বৃদ্ধি পেয়েছে দেশের সর্বত্র। শুধু দেশ বললেও ভুল হবে এখন, কারণ জন্মাষ্টমীর রমরমা এখন বিদেশেও পৌঁছে গিয়েছে। বর্তমানে বাড়িতে বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণের পুজো বা গোপাল ঠাকুরের পুজো করে থাকেন। পুজো করার আগে খুব নিষ্ঠাভরে রীতি-রেওয়াজ মেনে কৃষ্ণমূর্তিকে সাজানো হয়। হরেকরকম মিষ্টি ও সুস্বাদু সব খাবার নৈবেদ্য হিসেবে নিবেদন করা হয়। আধুনিক সময়ে বাড়ির ছোট্ট গোপালকে ময়ূরের পালক, সোনা বা রুপোর বাঁশি, পায়ে নূপুর, গলায় হার বা মাথায় মুকুট দিয়ে সাজান। সঙ্গে তো সুন্দর ও রঙিন পোশাক তো রয়েছেই। এইগুলি ছাড়া জন্মাষ্টমীর পুজো সম্পন্ন হয় না। তবে অনেকেই জানেন না যে, কৃষ্ণের দুই পায়ে শোভিত নূপুর কখনও এক হয় না। কারণ ডান পায়ের নূপুর বাম পায়ের নূপুরের থেকে বড় হয়। এর কারণ জানেন না অনেকেই।
পুরাণে উল্লেখ রয়েছে, ত্রেতা যুগে শ্রী বিষ্ণুর অবতার রূপে রামচন্দ্র মর্ত্যে পাপ নাশ করতে অবতীর্ণ হন। দুষ্ট রাবণ সীতাকে হরণের পর শ্রীরামচন্দ্র অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। স্ত্রীকে হারিয়ে রামচন্দ্র জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েন। তার ধনুক টি মাটিতে রেখে কান্না ভেঙে পড়ে ।সেই সময় তিনি রামধনুক মাটিতে রেখে কেঁদে আকুল হয়ে পড়েন। সেখানে তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন লক্ষণও। হঠাৎ লক্ষণ দেখতে পান, রামচন্দ্রের চোখের জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু যেখানে কাঁদছেন সেখানে চোখের জল পড়লেও রক্তবন্যা বয়ে যাচ্ছে। তার দুই নয়ন বেয়ে অশ্রুজল মাটিতে পড়ে রক্ত হয়ে নদীর সৃষ্টি করে। এমন দৃশ্য দেখে বিচলিত হয়ে লক্ষণ রামচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন,তাঁর চোখ থেকে অশ্রুজল মাটিতে পড়ে রক্তের আকারে বয়ে যাচ্ছে কেন?
তখন রামচন্দ্র তার ধনুকটি সরিয়ে দেখেন, তাঁর ধনুকটির নিচে একটি ব্যাঙ চাপা পড়ে মরনাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ধনুকের আঘাতেই ব্যাঙের শরীর থেকে রক্ত বয়ে চলেছে। ব্যাঙের রক্ত ও শ্রীরামের চোখের জল একসঙ্গে মিশে নদীর রূপ ধারণ করেছে। ঘটনার পর রামচন্দ্র বুঝতে পারেন, এই ব্যাঙ কোনও সাধারণ ব্যাঙ নয়। সেইসময় রামচন্দ্র ব্যাঙটিকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলেন, সর্পের দ্বারা আক্রান্ত হলে তো তুমি আর্তনাদ কর। তাহলে আমার ধনুকের নীচে চাপা পড়েও প্রতিবাদ করলে না কেন? উত্তরে ব্যাঙটি শ্রীরামকে প্রণাম করে বলেছিল, “প্রভু,যখন কোনও সর্প আমায় আক্রমণ করে, তখন আর্তনাদ করে আপনাকে নালিশ জানাই। কিন্তু যখন আপনার দ্বারাই আমার প্রাণসঙ্কটে তখন কাকে নালিশ জানাব?”
তখন রামচন্দ্র বললেন তুমি পুর্ব জন্মে কী ছিলে? ব্যাঙ তখন নিজের আসল পরিচয় দিয়ে বলল, “আমি পূর্বজন্মে কর্ণব মুনি ছিলাম। বিশ্বাবসু মুনি ছিলেন আমার গুরু। গুরুর চরণ সেবা করতে গিয়ে একদিন নখের আছড় লেগে গিয়েছিল। সেই ঘটনার পর গুরুদেব আমায় অভিশাপ দিয়েছিলেন, আমার পরজন্মে ব্যাঙ কুলে জন্ম হবে। অভিশাপের সঙ্গে সঙ্গে গুরু আমাকে আশির্বাদও দিয়েছিলেন যে, ত্রেতা যুগে শ্রী রামচন্দ্র অবতার রূপে জন্ম নিলে আমি পুনরুদ্ধার হব। সব কিছু শ্রবণ করার পর শ্রীরাম ব্যাঙকে বললেন “অবচেতন মনে হলেও তুমি আমার দ্বারা নিহত হয়েছ, তাই তোমার শেষ ইচ্ছে কী?” রামের কথার উত্তরে ব্যাঙ জানান, “আমার শেষ ইচ্ছা আমার গুরু যেনও অন্তিমকালে আপনার শ্রীচরণে ঠাই পান।”
তখন রামচন্দ্র ব্যাঙটিকে বলেছিলেন, আমি যখন পরের যুগে অর্থাৎ দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহণ করব, তখন তুমি থাকবে আমার ডান পায়ের নুপুর আর তোমার গুরুদেব বিশ্বাবসু হবেন আমার বাম পায়ের নুপুর। তবে দুজন ছোট বড় হয়ে আমার পায়ের নুপুর হয়ে থাকবে।” গুরু ও শিষ্যের ভেদ বোঝাতে বাম চরণে ছোট ও ডান চরণের নূপুর খানিকটা বড় হবে। এরপর দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়। তাঁক জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই দুষ্ট মামা কংসের কারাগারে শিশু কৃষ্ণের শ্রীচরণে ‘কর্ণব’ আর ‘বিশ্বাবসু’ দৈবযোগে নূপুর আকারে ঠাঁই হয়।