বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে অনলাইন সেলারের রমরমা। কেনা-বেচা থেকে প্রমোশন, আজকের দিনে অধিকাংশ মানুষই চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে। আর সেই প্ল্যাটফর্মকে সঙ্গী করেই নিজের আখ্যান লিখতে শুরু করেছিলেন বর্ষা সেন। সেই আখ্যান এখনও চলছে। আর চলার পথে সেই আখ্যানের পাতায় জুড়ে গিয়েছে বহু মানুষের ভাল থাকার ভাল গল্প।
মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম বর্ষার। ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল নিজের জন্য কিছু একটা করার। এমন কিছু, যা তাঁকে পরিচিতি দেবে। নিয়ে যাবে এক অন্য দুনিয়ায়। দু’চোখে সেই স্বপ্ন নিয়ে ঠিক ৭ বছর আগে স্বপ্নপূরণের পথে নেমে পড়েন বর্ষা। বেছে নেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে। প্রাথমিক স্তরে সেলার হিসাবেই কাজ করতে শুরু করেন বর্ষা। ব্যবসা কিছুটা পরিণত হওয়ার পরেই বর্ষার মাথায় আসে অন্যান্য মেয়েদের কথা। ‘এক জন মেয়ে হয়ে যদি আমি পারি, তা হলে অন্য মেয়েরা পারবে না কেন?’— কার্যত এই ভাবনা থেকেই মাত্র ১ বছরের মধ্যে বর্ষা তৈরি করেন ফেসবুক গ্রুপ ‘বর্ষা অ্যান্ড হার টিম ওম কালেকশনস’। বর্তমানে এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ।
বিভিন্ন ধরনের শাড়ি, ব্লাউজ, জামা সহ বিভিন্ন পরনের জিনিস কেনাবেচা করা হয় এই গ্রুপে। পাশাপাশি, অফলাইন ইভেন্টেরও আয়োজন করে এই গ্রুপ। এই গ্রুপের মাধ্যমে বহু মহিলা তাঁদের কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছেন। যদিও শুরুটা কিন্তু এতটাও সহজ ছিল না। বরং বলা ভাল, আজকের সাফল্যের নেপথ্যে লুকিয়ে রয়েছে বহু চড়াই উৎরাইয়ের গল্প।
২০১৭ সালে যখন এই গ্রুপ তৈরি হয়, তখন কিন্তু অনলাইন বাজার এখনকার মতো ততটাও জনপ্রিয় ছিল না। সেই সময় যেন আসন্ন ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলেন বর্ষা। আর তাই ব্যবসার মাধ্যম হিসাবে প্রাথমিকভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মকেই বেছে নেন তিনি। ২০১৯ সালের শেষ দিকে অতিমারি যখন সকলকে গ্রাস করতে থাকে, সেই সময়েও শক্ত হাতে এই গ্রুপ সামলে ছিলেন তিনি। সেই সময় তাঁর উপরে ভরসা করেই বহু মহিলার সংসার চলেছিল। মাতৃস্নেহে সকলকে আগলে রেখেছিলেন তিনি। প্রথম থেকেই বর্ষাকে হার না মানা লড়াইয়ের পাঠ শিখিয়েছিলেন তাঁর মা রত্না গোস্বামী। মায়ের দেখানো সেই পথে হেঁটেই সব প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন বর্ষা।
সেই অতিমারির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বর্ষা বলেন, “করোনার সময় যখন ঘরে ঘরে অভাব অনটন শুরু হয়, তখন অনেক মেয়ে আমাকে ফোন করে বলে, দিদি আমাদের বাঁচাও। অনেকের বাড়ির সকলের কাজ চলে গিয়েছিল। সবাই-ই প্রায় বাড়ি বসেছিল। হাতে টাকা ছিল না। অনেকের স্বামী মারা গিয়েছেন। সেই সময়ে ওদের চোখের জল আমাকে আরও শক্ত করে তোলে।”
অতিমারির সময় বর্ষা একটি বড় দল তৈরি করেন। মাতৃস্নেহে সকলকে আগলে রেখে, তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ান তিনি। বাড়িতে অক্সিজেনের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অসুস্থদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, সব ক্ষেত্রেই সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল বর্ষা ও তাঁর দল। প্রত্যেকের হাতে অর্থের যোগান দিতে পরিবারের মহিলাদের নিজের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করান বর্ষা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই অফলাইনে তাঁদের নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন তিনি। এর পরে আর ঘুরে তাকাতে হয়নি বর্ষাকে। দলের প্রত্যেকের সহযোগিতায় আজ বর্ষার গ্রুপ দেশ পেরিয়ে বিদেশের মানুষের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বহু নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার রাস্তা দেখিয়েছে এই গ্রুপ।
এই প্রসঙ্গে বর্ষাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এক সময় বাড়ির ছেলেরা তাঁদের ঘরের মেয়েদের আটকে রাখতেন। অথচ আজ আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমার এই গ্রুপের মহিলাদের অনেকেই সংসার চালান। অনেকে পরিবারের এক মাত্র উপার্জনকারী সদস্য। তবে শুধু মাত্র মহিলাই নয়, আজ ছেলেদের, এমনকি রূপান্তরকামীদের কাছেও সঠিক ঠিকানা হয়ে উঠেছে আমার এই গ্রুপ।” বর্তমানে অনলাইন এবং অফলাইন, দুই জায়গাতেই কাজ করছে বর্ষার দল। প্রদর্শনীর আয়োজন করলে, বহু মানুষ বাইরে থেকে আসেন, শুধুমাত্র প্রদর্শনী দেখবেন বলে।
সময় বদলে যায় সময়ের মতো করে। সেই সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়েই আজ নিজের অবস্থানে পৌঁছেছেন বর্ষা। তবে লক্ষ্য অনেক বড়। বর্তমানে বহু নারীদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা। নিজের গ্রুপের প্রত্যেক সদস্যদের প্রতি তাঁর মাতৃত্বসুলভ আচরণ সত্যিই প্রশংসার অবকাশ রাখে না। তাঁর মাতৃস্নেহে আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন বহু নারী। বহু মানুষ খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের বাঁচার রসদ। এই মাতৃদিবসে বর্ষাকে কুর্ণিশ। তাঁর আশা, আগামী দিনে এই গ্রুপ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজের পায়ের মাটি শক্ত করতে সাহায্য করবে।
আপনিও জুড়ে যেতে পারেন ‘বর্ষা অ্যান্ড হার টিম ওম কালেকশনস’-এর সঙ্গে। ভিজিট করুন পাশের লিঙ্কে—
Facebook Links- https://www.facebook.com/borsha.sen.334?mibextid=ZbWKwL