
অভিষেক সেনগুপ্ত
সুনীল গাভাসকরের ১২ বল আর ১৪ মিনিটের ‘সংক্ষিপ্ত জীবন’ নিয়ে চর্চা শুনেছেন? বীরেন্দ্র সেওয়াগের ২ মিনিটে ২ বলের ওই শূন্যপতন নিয়ে? কিছু সংখ্যা জন্ম নেয়। আলোচনায় আসে না। চাপা পড়ে যায় উৎসবে। আনন্দে। চোখের জলে। ইতিহাসের মহিমায়। কাপের ঝলকানিতে!
যে কারণে মহিন্দারের ‘অমরনাথ’ যাত্রা অমর! যে কারণে ‘মহেন্দ্র’ক্ষণ হয়ে আছেন ধোনি! ভাঙনের মুখে যাঁরা প্রতিরোধ গড়েন, ইতিহাস মনে রাখে তাঁদেরই। গৌতম গম্ভীর ভালোবাসায় থাকবেন, বিস্ময়ে নন। মদন লাল হৃদয়ে থাকবেন, ঈর্ষায় নন!
মেয়েদের ইতিহাসে পৌঁছে দিলেন কে? মুম্বই কাকে পরাল নেকলেস? যে মেয়েটা জাতীয় দলেই ছিলেন না ১৩ মাস? যে মেয়েটা জানতেনই না সেমিফাইনাল খেলবেন? ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে-খেলতে আচমকা ডাক পাবেন বিশ্বকাপ দলে? যে মেয়েটা ব্যাট করতে পারেন? বলও করতে পারেন? যে মেয়েটা নাচিয়ে দিতে পারেন পুরো গ্যালারি? যে মেয়েটা কাঁদিয়ে দিতে পারেন একটা পুরো দেশকে?
কে তিনি? রোহতকের ছোটখাট মেয়েটা। শেফালি ভার্মা! ওপেন করতে নেমে করেছিলেন ৮৭। বল করতে এসে? পার্টটাইম অফস্পিনার পকেটে পুরলেন সান লুস আর মারিজেন কাপের উইকেট। যেন মেয়েদের বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের হয়ে ব্যাট হাতে নামলেন ধোনি। বল করলেন অমরনাথ!
১৯৮৩ সালের পর ২০১১— কপিল দেবের পর ২৮ বছরের অপেক্ষার অবসান হয়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির হাত ধরে। ১৪ বছর পর আর একটা ওয়ান ডে বিশ্বকাপ। এবারও সেই মুম্বই। মেয়েদের বিশ্বসেরার মঞ্চে হরমনপ্রীত কৌরের ভারত। ছেলেরা ওয়ান ডে, টি-টোয়েন্টি দুই বিশ্বকাপই জিতেছে। কিন্তু মেয়েরা কাছে পৌঁছেও ফিরছিল বারবার। একটা অমরনাথ, একটা ধোনির জন্য। দুই ভূমিকায় একাই অবতীর্ণ হলেন ২১ বছরের শেফালি। ৮৩র বিশ্বকাপের পর ভারত তো বটেই, কপিল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছিল সারা উপমহাদেশ। ২০১১ সালের পর ঘরে-ঘরে জন্ম হয়েছিল ধোনি হওয়ার স্বপ্ন। ক্রিকেটে প্রথম বিশ্বকাপ লাখো লাখো মেয়েকে দেখাবে শেফালি হওয়ার সোনালি স্বপ্ন। মিতালি রাজকে নিয়ে হয়েছে। ঝুলন গোস্বামীকে নিয়েও। শেফালির বায়োপিকও সময়ের অপেক্ষা। হয়তো ধোনির মতো, খেলতে খেলতেই।
অস্ট্রেলিয়াকে সেমিফাইনালে হারিয়ে ফাইনালে ওঠা ভারতই ফেভারিট ছিল। কিন্তু লরা উলভার্টের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে কঠিনতম প্রতিপক্ষই ধরা হচ্ছিল। টসে জিতে ভারতকে ব্যাটিং করতে পাঠিয়ে প্রোটিয়া ক্যাপ্টেন চেয়েছিলেন শিশির কাজে লাগাবেন। ভারতীয় বোলারদের মুশকিলে ফেলবেন। দুটোর কোনওটাই হল না।
শেফালি আর স্মৃতি মান্ধানা মিলে ভারতকে ওপেনিং জুটিতে ১০০র বেশি রান দিয়েছিলেন। স্মৃতি সেমিতে রান পাননি। ফাইনালে বড় রানের হাতছানি ছিল। কিন্তু ৪৫ করে ফেরেন। শেফালি ৭৮ বলে ৮৭ করেন। ৭টা চার ও ২টো বিশাল ছয় দিয়ে সাজিয়েছেন ইনিংস। জেমাইমা রড্রিগস সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি করে হারিয়েছিলেন অজিদের। কিন্তু ফাইনালে ২৪ করেন। হরমনপ্রীত কৌরও ২০তে থামেন।
এখান থেকেই আবার খেলা ধরেন দীপ্তি শর্মা। সিনিয়র, নির্ভরশীল, অলরাউন্ডার, ঠান্ডা মাথার— চার স্কিলেই হাফসেঞ্চুরি করে গেলেন দীপ্তি। শেষ দিকে ভারতকে দ্রুত ২৯৮এ নিয়ে গেলেন বাংলার রিচা ঘোষ। শিলিগুড়ির মেয়ে বড় শট নিতে পারেন। যে কোনও মুহূর্তে পাল্টে দিতে পারেন খেলার গতি। ফাইনালেও তাই করেছেন। ২৪ বলে ৩৪এ রয়েছে ২টো বল হারানো ছয়, তিনটে চমৎকার চার।
সব মহাকাব্যেরই একটা গোপন এভারেস্ট থাকে। যার ওপারে থাকে স্বপ্নপূরণ। ইতিহাস। ৮৩তে সেই এভারেস্টের নাম ছিল ভিভ রিচার্ডস। ২০১১ সালে সেই এভারেস্ট ছিলেন মুথাইয়া মুরলীথরন। মুম্বইয়ে হ্যারি, স্মৃতি, শেফালিদের সামনে ছিলেন লরা উলভার্ট। একদিকে ভাঙন, অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপ্টেন। আসা-যাওয়ার মাঝে যেন একার মুঠোয় স্বপ্ন বহন করলেন লরা। সেমিফাইনালে করেছিলেন ১৬৯। ফাইনালেও তাঁর ব্যাটে দুরন্ত সেঞ্চুরি। কিন্তু ১০১ করে ফিরলেন উলভার্ট।
শেফালি যদি ভারতের সোনালি রেখা হন, তবে ভারতের জয়ের সিলভার লাইন দীপ্তি শর্মা। ব্যাটে হাফসেঞ্চুরি। বল হাতে চার-চারটে গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। যখন বল গ্রিপ করতে সমস্যা হচ্ছে শিশিরের জন্য, তখনই ভারতকে দীপ্তি দিলেন অফস্পিনার। তাঁর নবম ওভারটাও ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। পর পর উলভার্ট সহ নিলেন আরও একটা উইকেট। চাপের ম্যাচে প্রোটিয়ারা কবে আর ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১১ ভারতীয় কন্যা যে প্রতিপক্ষকে মাথা তুলতে দেবেন না, প্রতিজ্ঞা করেই নেমেছিলেন। ঠিক করে নিয়েছিলেন, যাই হোক না কেন ইতিহাসের দরজা খুলবেনই! দীপ্তি নিলেন ৫ উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ ২৪৬ রানে। ৫২ রানে জয় ভারতের।
একটা বিশ্বকাপ অনেকের কষ্ট মুছে দেয়। ৬ বিশ্বকাপ খেলেও মিতালি রাজ পারেননি। ৫টা বিশ্বকাপ খেলে পারেননি ঝুলন গোস্বামী। সব আক্ষেপ এক রাতে মুছে দিলেন হরমনপ্রীত, স্মৃতি, দীপ্তি, শেফালিরা। ভারতের ভাগ্য বিধাতা হয়ে!