জসপ্রীত বুমরা হোক বা মিচেল স্টার্ক। নিখুঁত ইয়র্কারে উইকেট ছিটকে দেওয়ার যে দৃশ্য…। সকলের কাছে তা দৃষ্টিনন্দন নাই হতে পারে। ফিল্ডিং টিমের কাছে অবশ্যই দুর্দান্ত মুহূর্ত। যে মুহূর্ত বারবার ফেরানোরই লক্ষ্য থাকে বোলারদের। আর ব্যাটারদের নজর বল গ্যালারিতে ওড়ানোয়। আর এই লড়াই ক্রিকেটের গ্ল্যামার বাঁচিয়ে রাখে। কখনও ব্যাটার জেতে, আবার উল্টোটাও হয়। ধারাভাষ্যকারদের মুখে গোল্ডেন ডাক শুনতে আমরা অভ্যস্ত। শূন্যতে আউট হলে শুধু ‘ডাক’-ও অনেক ক্ষেত্রেই শোনা যায়। ‘ডাক’-এ সাড়া দিতে কোন ব্যাটারই বা চান! কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ভাগ্য-সময় সঙ্গ দেয় না। আচ্ছা ক্রিকেটে কি শুধুই গোল্ডেন ডাক? নাকি আরও কিছু! চলুন খোঁজ নেওয়া যাক, ক্রিকেটে আর কী কী আছে ‘ডাক’!
ব্যাটাররা যেন কয়েকটা অলিখিত মন্ত্র জপতে জপতে মাঠে নামেন। প্রথম বলে ফেরা যাবে না, শূন্য রানে আউট একদম নয়! কিন্তু তারপরও তো এমন হয়। সবচেয়ে হতাশার, প্রথম বলেই আউট হওয়া। কেউই চান না তাঁর সঙ্গে এমন পরিস্থিতি তৈরি হোক। বরং, বাইশ গজে যাওয়ার সময় মাথায় থাকে একটা ভালো ইনিংস খেলে টিমের জন্য অবদান রাখার। ড্রেসিংরুমে ফেরার আগে যেন কিছুটা তৃপ্তি থাকে। সব সময় সেটা সম্ভব হয় না। তা হলে ডাক-এর ডাকে ফেরা যাক।
গোল্ডেন ডাক-অতি পরিচিত শব্দ। প্রথম বলে শূন্য রানে আউট হলেই এই ওয়ার্ড শোনা যায়। বোলার এবং ফিল্ডিং টিমের জন্য তা উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত হলেও ব্যাটারদের জন্য চূড়ান্ত ‘লজ্জার’। সে তারকা ব্যাটারই হোক বা উঠতি কোনও প্রতিভা। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ, ধারাভাষ্যকার কিংবা প্লেয়ারদের কাছেই নয়, সমর্থকরাও এই গোল্ডেন ডাক-এর সঙ্গে পরিচিত। কোনও ব্যাটার নিজের ইনিংসের প্রথম ডেলিভারিতে আউট হলেই তা গোল্ডেন ডাক। ক্রিকেটে অহরহ দেখা যায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশিবার গোল্ডেন ডাক-এর শিকার শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি স্পিনার মুথাইয়া মুরলিধরন। স্পেশালিস্ট ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল্ডেন ডাক শ্রীলঙ্কারই বিশ্বজয়ী দলের সদস্য সনৎ জয়সূর্যর! কেরিয়ারে ৫৮৬ আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে ৫৩ বার গোল্ডেন ডাক হয়েছেন।
সিলভার ডাক– গোল্ডেন যখন রয়েছে, সিলভারও নিশ্চয়ই থাকবে! রয়েছে তো! কোনও ব্যাটার যখন নিজের ফেস করা দ্বিতীয় বলে শূন্য রানে ফেরেন, সেটিকে সিলভার ডাক বলা হয়ে থাকে। যদিও এই টার্ম খুব একটা শোনা যায় না। এমনকি ধারাভাষ্যকাররা গোল্ডেন ডাকের ক্ষেত্রে যে ভাবে নির্দিষ্ট করে বলেন, সিলভার ডাকের ক্ষেত্রে তেমনটা শোনা যায় না। তাঁরা কী বলেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বলেন, ‘সেকেন্ড বল ডাক’।
ব্রোঞ্জ ডাক-শুনতে অদ্ভূত লাগছে! এ কি অলিম্পিকের পদক নাকি? বিষয়টা যেন তেমনই। অনেকেই অবশ্য শোনেননি। কারণ, এর ব্যবহারও হয় না বললেই চলে। বলা যেতে পারে তৃতীয় ডেলিভারিতে শূন্য রানে ফিরলে ব্রোঞ্জ ডাক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অবশ্য তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ব্যাপার নেই। তবে এমন ডাক ব্যাটার কিংবা দর্শকদের কাছে ‘বোরিং’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
ডায়মন্ড ডাক– শুনতে যতটা ‘আভিজাত্য’ মনে হোক, ব্যাটারের ক্ষেত্রে অবশ্য এর চেয়ে হতাশার কিছু নেই। এলাম, খেললাম না, কিন্তু আউট হয়ে গেলাম! এমনটা অনেক সময়ই হয়ে থাকে। বোঝাপড়ার ভুলেই মূলত। ব্যাটার নামলেন, কিন্তু স্ট্রাইক পেলেন না। উল্টে রান আউট হয়ে ফিরে গেলেন। কোনও বল না খেলেই এই আউটকে ডায়মন্ড ডাক বলা হয়। শুধু রান আউটের ক্ষেত্রেই নয়, টাইমড আউট হলেও তাই। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ, ২০২৩ ওডিআই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কা ম্যাচ। টাইমড আউট হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার ব্যাটার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ।
রয়্যাল ডাক-ক্রিকেট একটা সময় বড়লোকদেরই খেলা ছিল। সত্যিই রয়্যাল ব্যাপার জড়িত। তবে রয়্যাল ডাক ব্যাটারদের কাছে আরও বড় দুঃস্বপ্নের। রয়্যাল ডাক-এর ক্ষেত্রে ‘দুর্ভাগ্যবান’ ওপেনিং ব্যাটাররাই। নিজেরই শুধু নয়, ইনিংসের প্রথম ডেলিভারিতে আউট হলে সে সময় ‘রয়্যাল ডাক’ বলা হয়ে থাকে। তবে রয়্যাল ডাকের ক্ষেত্রে তর্কেরও জায়গা রয়েছে।
প্ল্যাটিনাম ডাক– অনেক সময় রয়্যাল ডাক-কে প্ল্যাটিনাম ডাকও বলা হয়ে থাকে। কারণ, এখানে প্রথম ইনিংস না দ্বিতীয় ইনিংস এই নিয়ে তর্কের জায়গা রয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ডেলিভারিতে আউটের ক্ষেত্রে যতটা সহজ করে ভাবা যায়, প্ল্যাটিনাম কিংবা রয়্যালের ক্ষেত্রে নয়। কোনও টেস্টের প্রথম ইনিংসের প্রথম ডেলিভারিতে আউট হলে প্ল্যাটিনাম ডাক বলা যেতে পারে। ২০২১ সালের অ্যাসেজ সিরিজে ররি বার্নসের ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর চেয়েও বেশি কিছু বলা যায়! তিনি শুধু ম্যাচ কিংবা ইনিংসের প্রথম ডেলিভারিই নয়, সিরিজেরই প্রথম ডেলিভারিতে মিচেল স্টার্কের বোলিংয়ে আউট হয়েছিলেন।
লাফিং ডাক-এর সঙ্গে লাফালাফির কোনও সম্পর্ক নেই বরং হাসির বিষয় বলা যায়। এবং এই আউট অহরহ হয়। যখন কোনও ব্যাটার ইনিংসের শেষে শূন্য রানে ফেরেন অর্থাৎ তাঁর শূন্য রানে আউট হওয়াতে ইনিংসেরই সমাপ্তি ঘটে, সেক্ষেত্রে লাফিং ডাক ব্যবহার করা হয়। এটি অবশ্য মজা করেই বলা হয়ে থাকে। লোয়ার অর্ডার ব্যাটার ইনিংসের শেষ বলে আউট হলে তাতে লজ্জার কিছু নেই।
পেয়ার-শব্দটির মধ্যেই এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে যেন। কোনও ব্যাটার যদি দু-ইনিংসেই শূন্য রানে ফেরেন (সেটা যে কোনও ডাকই হতে পারে), সেক্ষেত্রে ‘আ পেয়ার’ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ১৯৯৪ সালে করাচিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ব্যাটার মার্ক টেলর দু-ইনিংসেই শূন্য রানে ফিরেছিলেন।
কিং পেয়ার- এটির ক্ষেত্রে পেয়ারের মতোই বলা যায়। তবে ফারাক রয়েছে। কোনও ব্যাটার যদি একই ম্যাচের দু-ইনিংসে গোল্ডেন ডাক হয়ে ফেরেন, সেক্ষেত্রে কিং পেয়ার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০১ সালে ইডেন গার্ডেন্স এমনই ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছিল। ফলো অন খেয়েও সেই টেস্ট জিতেছিল ভারত। রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষ্মণের সেই মহাকাব্যিক জুটি। সেই ম্যাচেই চূড়ান্ত লজ্জার মুখোমুখি হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কিপার ব্যাটার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। প্রথম ইনিংসে হরভজন সিং তাঁকে প্রথম ডেলিভারিতেই ফেরান। দ্বিতীয় ইনিংসে সচিন তেন্ডুলকরের বোলিংয়ে গোল্ডেন ডাক গিলক্রিস্ট।
দুই ইনিংসেই গোল্ডেন ডাক অর্থাৎ কিং পেয়ারের অন্যতম উদাহরণ ইডেন টেস্ট। ব্যাটারদের ক্ষেত্রে যেন বলা যায়, কোনও ডাকেই ‘সাড়া’ না দেওয়াই শ্রেয়, তেমনই ডাক-এ ‘সারা’ও! ব্যাটে বল লাগিয়ে কোনওরকমে রানের খাতাটা অন্তত খুলতে পারলেই চিন্তা-মুক্ত!