মারাদোনার রাজনীতি: সর্ব শক্তি দিয়ে ঘৃণা করি আমেরিকাকে

TV9 বাংলা ডিজিটাল: ২০০৭, অগস্ট মাস। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেসের (Hugo Chávez) একটি সাপ্তাহিক টেলিভিশন শো পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছিল দিয়েগো মারাদোনার (Diego Maradona) কাঁধে। ওই শোয়ের বিষয়বস্তু ছিল, আমেরিকাকে আপাদমস্তক গালমন্দ করা। বামপন্থী দিয়েগো যে এই কাজে সিদ্ধহস্ত, তা সর্বজনবিদিত। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমেরিকার সব কিছুই আমি ঘৃণা করি। আমার সর্ব শক্তি দিয়ে ঘৃণা […]

মারাদোনার রাজনীতি: সর্ব শক্তি দিয়ে ঘৃণা করি আমেরিকাকে
Follow Us:
| Updated on: Nov 26, 2020 | 3:33 PM

TV9 বাংলা ডিজিটাল: ২০০৭, অগস্ট মাস। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেসের (Hugo Chávez) একটি সাপ্তাহিক টেলিভিশন শো পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছিল দিয়েগো মারাদোনার (Diego Maradona) কাঁধে। ওই শোয়ের বিষয়বস্তু ছিল, আমেরিকাকে আপাদমস্তক গালমন্দ করা। বামপন্থী দিয়েগো যে এই কাজে সিদ্ধহস্ত, তা সর্বজনবিদিত। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমেরিকার সব কিছুই আমি ঘৃণা করি। আমার সর্ব শক্তি দিয়ে ঘৃণা করি।’ যে বিশ্ব বিখ্যাত ফুটবলারের জীবন এত প্রেম, আবেগ, নেশা, যৌনতায় ভরপুর, সেই জীবনেও জায়গা পেয়েছিল কদর্য ঘৃণা! ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশকে এতটা ঘৃণা করতেন বলেই, হয়ত ‘কমরে়ড’ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন লাতিন আমেরিকার দিয়েগো মারাদোনা। আম লাতিন আমেরিকানদের প্রতিনিধি ছিলেন ফুটবলের রাজপুত্র।

শৈশব কেটেছে অত্যন্ত দারিদ্রে। বুয়েনস আরেসের বস্তি শহর ভিলা ফিওরিতে তাঁর বেড়ে ওঠা। ছোট্ট একটি ঘরে সাত ভাইবোনের সঙ্গে দিন যাপন। সূর্য ঢলে পড়লে ঝুপ করে অন্ধকার নামত বস্তিতে। তখন বিদ্যুৎহীন নিকষ আঁধারে রাতভর স্বপ্ন ফুটিয়ে তোলার লড়াই চলত মারাদোনার। তাঁর কাকা সিরিলো চিৎকার করে বলতেন, “দিয়েগিতো, সব সময় মাথা উঁচিয়ে রেখো।” ক্ষুধার্ত পেটে পুঁথিগত বিদ্যা সেভাবে না থাকলেও ওই পা দুটি ছিল ফুটবল বিদ্যায় পুষ্ট। ৩ বছর বয়স থেকেই ফুটবলে মজেছিলেন দিয়গো।

তবে, আদুর শরীর আর খালি পায়ে অলিগলিতে ফুটবল খেলে বেড়ানো ছেলেটির রাজনৈতিক ধ্যানধারণাও তৈরি হয় রাস্তা থেকেই। গরিবি ছিল তাঁর খুব কাছের। আর্জেন্তিনার (Argentina) নায়ক চে গেভারার গল্প শুনে তাঁর আবাল্য কাটে। চে আর ফিদেল, বাতিস্তা সরকারের কীভাবে পতন ঘটিয়ে বুর্জুয়া শক্তির ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল সে গল্প তাঁকে উদ্বুদ্ধ করত। আমেরিকার পুঁজিবাদ, রাষ্ট্র শক্তির আস্ফালনের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকার গরিব দেশগুলির মানুষের মনের মধ্যে যে ক্ষোভ তিলে তিলে পুঞ্জীভূত হয়েছিল, মারাদোনাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, চে-ফিদেলের শত্রু তাঁরও শত্রু। চাভেসের শোয়ে তিনি বলেছিলেন, ফিদেল যা কিছু করেন, সেটাই আমার ঠিক মনে হয়।

২০০৫ সালে মার দেল প্লাতায় এক সম্মেলনে এসেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (George Bush)। ইরাক যুদ্ধে বুশের তৎপরতায় বিশ্বজুড়ে তখন সমালোচনার ঝড়। আতলান্তিক উপকূলে আর্জেন্টিনার ওই ছোট্ট শহরে সেই ঝড় আছড়ে পড়েছিল। বুশের বিরোধিতায় কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ-মিছিল করেন। সেদিন বুশ বিরোধী টি-শার্ট পরে প্রতিবাদ জানান দিয়েগো মারাদোনাও। তাঁর ওই টি-শার্টে লেখা ছিল “স্টপ বুশ”। ইংরেজির ‘এস’ অক্ষরটি ছিল ‘স্বস্তিক’ চিহ্নের মতো যেটি হিটলারের নাৎসির নারকীয়তাও বহন করে। মারাদোনার কথায়, “বুশ ছিলেন মানব ত্রাস, ওর বিরোধিতা করতে পারায় আমি গর্বিত”।

MARADONA

ফুটবলের রাজপুত্রকে শ্রদ্ধাঞ্জলি (সৌজন্যে-টুইটার)

ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে মারাদোনার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। কাস্ত্রো না থাকলে মারাদোনার শেষ জীবন হয়তো অন্য খাতে বইত, এ কথা তিনি বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। মাদকাসক্ত মারাদোনার যখন নিজের দেশে ঢোকার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল তাঁকে আশ্রয় দিয়ে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনেন। ফিদেলের মৃত্যুতে মারাদোনার শোকার্ত আর্তি ছিল, “আমার দ্বিতীয় পিতাকে হারালাম”। ফিদেলের পাশাপাশি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেস, মাদুরোর সঙ্গে সম্পর্ক যত দৃঢ় হয়, ততই মার্কিন আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে মারাদোনার সুর আরও জোরালো হয়েছে।

সদ্য বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ‘কার্টুন’ চরিত্র বলে কটাক্ষ করতেন মারাদোনা। তাঁর কথায়, “যখনই মার্কিন রাজনীতির কথা ওঠে, ট্রাম্পকে কার্টুন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। টিভিতে ওর মুখ দেখলেই চ্যানেল বন্ধ করে দিই”। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়া আসা-সহ ইরান পরমাণু চুক্তি, প্যালেস্তাইন-ইজ়রায়েল ইস্যু নিয়ে বরাবারই আমেরিকার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তিনি। গাজ়ায় ইজ়রায়েলের ভূমিকার সমালোচনা করে মারাদোনা বলেছিলেন, “আমি মনে প্রাণে প্যালেস্তানীয়।” তবে, বুশ কিংবা ট্রাম্পের বিরোধিতা করলেও ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি তাঁর নরম মনোভাব ছিল। আস্থা ছিল, লাতিন দেশগুলির সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে তৎপর হবেন ওবামা।

২০০৮ -এ মুম্বই হামলার পরপরই কলকাতায় এসেছিলেন মারাদোনা। নেহাতই সৌজন্যের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘ফুটবলের মক্কা’ কলকাতায় তাঁর আগমন ঘটেছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। বসুর বন্ধু স্থানীয় ফিদেলের কুশল বার্তা জানান মারাদোনা। কলকাতায় এসে তিনি এখানকার মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি বুঝেছিলেন। তাই নিজের রাজনৈতিক সত্ত্বাকেও উজাড় করে দিতে ভোলেননি মারাদোনা। কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠকে মারাদোনা বলে যান, জর্জ বুশ একজন হত্যাকারী। তবে, ওবামার প্রতি আমার আস্থা আছে, ভাল কিছু করবেন তিনি। আর এ শহর যে তাঁর নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোকে মনে প্রাণে ভালবাসে, সে কথাও জানিয়ে যান দিয়েগো আর্মাদো মারাদোনা। ফলে ১০ নম্বর জার্সির চিরকেলে মালিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এক সুদৃঢ রাজনীতি মনস্ক মানুষও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, এ কথা বলাই যায়।