FIFA World Cup: ব্ল্যাক স্পাইডার, ব্ল্যাক প্যান্থার, ব্ল্যাক অক্টোপাস…আর কী নামে ডাকা যায় তাঁকে?

Lev Yashin: নায়ক হওয়ার পরও লেভ ইয়াসিনের জীবনে খারাপ সময় এসেছিল। 'বিউটিফুল গেম' সবসময় বিউটিফুল হয় না। ১৯৬২ ফিফা বিশ্বকাপই যেমন। কোয়ার্টার ফাইনালে এমন দুটি গোল খেয়েছিলেন, যেটা তাঁর মতো কিংবদন্তির কাছে প্রত্যাশিত নয়। তবে ওই যে, মানুষের ভুল হয়। তাঁরও হয়েছিল। গোলের দায় তাঁর একার ছিল না। যদিও তাঁকেই খলনায়ক করা হয়েছিল।

FIFA World Cup: ব্ল্যাক স্পাইডার, ব্ল্যাক প্যান্থার, ব্ল্যাক অক্টোপাস...আর কী নামে ডাকা যায় তাঁকে?
Image Credit source: OWN Photograph
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 21, 2022 | 10:03 PM

দীপঙ্কর ঘোষাল

নতুন তারকা কে? এই প্রশ্ন চার বছর অন্তত ঠিক ঘোরাফেরা করে মাথায়। বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে এ বারও আমরা বসব মেসি-রোনাল্ডো-নেইমারের পরবর্তী প্রজন্মের খোঁজে। বিশ্বকাপ এমনই। তার পথচলার প্রথম দিন থেকেই জন্ম দিয়ে চলেছে একের পর নায়ক। অসংখ্য ঘটনা। আর একদল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সেই সব নায়ক আর না-ভোলা ঘটনা তুলে আনল টিভি নাইন। পর্ব-৫

‘ইউরি গ্যাগারিনকে মহাকাশে দেখার সুখ ছাপিয়ে যেতে পারে, একটা ভালো পেনাল্টি সেভ দেখে।’ লেভ ইয়াসিন সম্পর্কে এ কথাই বলা যায়। দেড়শোর বেশি পেনাল্টি কোন কিপার কি বাঁচিয়েছেন? প্রশ্নটা কি বোকা বোকা শোনাচ্ছে? গোলরক্ষকের কাজই তো গোল বাঁচানো। তাহলে এ নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে? কিন্তু গোল খেলে, সকলেই ভুলে যায় গোলরক্ষকও মানুষ। যাবতীয় দায় তাঁর হতে পারে না। ফুটবলে স্ট্রাইকারের যতটা গুরুত্ব, বাকিদেরও তাই। তা সত্ত্বেও আমরা আঙুল তুলি কিপারের দিকে!

এমন একজন গোলরক্ষকের বলা যেতে পারে, যিনি ছিলেন প্রায় নিখুঁত। যত ‘ভুল’ করেছেন, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি করেছেন ‘ঠিক’। লেভ ইয়াসিন। এ তো গেল একটা নাম। কিপিংয়ে নবজাগরণ আনা ইয়াসিনকে আরও অনেক নামে ডাকা হয়। ব্ল্যাক স্পাইডার, ব্ল্যাক প্যান্থার, ব্ল্যাক অক্টোপাস…!

সোভিয়েত ইউনিয়নের এই গোলরক্ষকের পছন্দ ছিল কালো পোশাক। মাঠে নামতেন কালো জার্সিতেই। সেই থেকেই ‘ব্ল্যাক’। বাকি বিশেষণগুলো স্বাভাবিক ভাবেই জুড়ে গিয়েছে। মাকড়সার মতো তাঁর জালে বল আটকে যেত। ব্ল্যাক প্যান্থারের মতোই ক্ষিপ্রতায় গোল বাঁচাতেন। অক্টোপাসের মতো অনেকগুলো হাত ছিল যেন। গোলে বল জড়াতে গেলে, অনেক বাধা পেরোতে হয়। শেষ ধাপে গোলরক্ষক। আর লেভ ইয়াসিন ছিলেন দুর্ভেদ্য প্রহরী। তাঁকে পরাস্থ করতে প্রয়োজন হত অবিশ্বাস্য দক্ষতার।

ব্ল্যাক স্পাইডারের জীবনও অন্ধকার থেকে আলোয় এসেছে। ১৯২২ সালে জন্ম লেভ ইয়াসিনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ছোট্ট বয়স থেকেই অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করতে হয়। যুদ্ধের অস্ত্র বানানোর কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মানসিক অবসাদেও ভুগেছেন একসময়। আত্মজীবনীতে ইয়াসিন লিখেছেন, ‘ওই সময়ে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারতাম না।’ আর তা কাটাতে ভরসা ছিল ফুটবল। কারখানায় অন্যান্য শ্রমিকদের সঙ্গে খেলতেন। রুগ্ন চেহারার কারণে তাঁকে গোলেই দাঁড়াতে হত। সেখান থেকে রূপকথার শুরু। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার পথ তৈরি হয়। কারখানার কাজ ছাড়তে চাইছিলেন। উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এক বন্ধুর পরামর্শে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল ফুটবলে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল ডায়নামো মস্কোর। সেনাবাহিনীতে খেলার সময় ডায়নামো কর্তার নজরে পড়েন ইয়াসিন। সেই তিনিই যে সর্বকালের সেরা গোলকিপার হবেন, কেই বা জানত!

ডায়নামো মস্কোয় শুধুমাত্র ফুটবলই নয়, হকি দলের গোলও সামলেছেন। ১৯৫৩ সালে হকি চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন ইয়াসিন। ফুটবলে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের জন্য ডায়নামো মস্কোর সিনিয়র দলে সুযোগ পান। সোভিয়েত ইউনিয়ন ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে পাঁচ বার এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কাপে তিন বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল লেভ ইয়াসিনের।

ইয়াসিন অবশ্য মনে থেকে গিয়েছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে অনবদ্য পারফরম্যান্সের জন্য। কেরিয়ারের অন্যতম সেরা সাফল্য ১৯৫৬ সালের অলিম্পিকে সোভিয়েতের সোনা জয়। ১৯৬০ সালে ইউরোপিয়ান নেশন্স কাপও জিতেছেন। ১৯৫৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে নায়ক হয়ে ওঠেন ইয়াসিন। অবিশ্বাস্য গোল বাঁচানো, পেনাল্টিতে দুর্ভেদ্য। ইয়াসিন সম্পর্কে আর এক কিংবদন্তি এবং বন্ধু ইউসেবিও বলেছিলেন, ‘ওকে গোল পোস্টের তলায় দেখলে অনেক তারকার আত্মবিশ্বাস তলানিতে চলে যেত।’

ভাঙা হাড়, কনকাশন নিয়েও খেলেছেন ইয়াসিন। এমনই ছিল জেদ। রক্ষণভাগের নেতা। সারাক্ষণ ডিফেন্ডারদের নির্দেশ দিয়ে যেতেন। বক্স থেকে দ্রুত যেমন এগিয়ে যেতেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত বক্সের ফেরার ক্ষমতাও ছিল। আগ্রাসন এবং নিখুঁত পাস বাড়ানোর অবিশ্বাস্য দক্ষতা ছিল।

সব নায়কের জীবন মসৃণ হয় না। লেভ ইয়াসিন সেই বিরল কিছু লোকের তালিকায় ছিলেন। ‘বিউটিফুল গেম’ যে সবসময় বিউটিফুল হয় না, বুঝেছিলেন বিশ্বের সেরা কিপার। ১৯৬২ সালের ফিফা বিশ্বকাপ যেমন। কোয়ার্টার ফাইনালে এমন দুটি গোল খেয়েছিলেন, তাঁর মতো কিংবদন্তির কাছে কেউ প্রত্যাশা করেনি। তবে ওই যে, ভুল মানুষেরই হয়। তাঁরও হয়েছিল। গোলের দায় তাঁর একার ছিল না। যদিও তিনি খলনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে গোল খাওয়ার আগে কনকাশন হয়েছিল ইয়াসিনের। সোভিয়েত সংবাদমাধ্যমে সে কথা এড়িয়ে গিয়ে বড় করে দেখিয়েছিল ইয়াসিনের ব্যর্থতা। ওই একটা ম্যাচ ক্ষত হয়ে গিয়েছিল ইয়াসিনের। তাঁর বাড়ি, গাড়ি ভাঙচুড় করা হয়েছিল। এমনকি খুনের হুমকিও দেওয়া হয়।

সব তারকা পারেন না। কিছু কিছু তারকা পারেন সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নিতে। ইয়াসিনও মসনদে ফিরতে পেরেছিলেন। আবার মাথায় তুলে নিয়েছিলেন তাজ। ১৯৬৩ সালে ব্যালন ডি’ওর জিতেছিলেন। বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে ব্যালন ডি’ওর জয়ী একমাত্র গোলরক্ষক লেভ ইয়াসিন। সে ইতিহাস আজও পাল্টায়নি। বিশ্ব ফুটবলে অনেক গোলরক্ষক এসেছেন। সর্বকালের সেরা একজনই। ব্ল্যাক স্পাইডার, লেভ ইয়াসিন।