অভিষেক সেনগুপ্ত
ইতিহাস বোধহয় এ ভাবেই ফিরে আসে। জোড়া পদক কি আসেনি অলিম্পিক থেকে? এসেছে। সুশীল কুমার এনেছেন। পিভি সিন্ধু এনেছেন। এঁদের পদক প্রাপ্তি পর পর দুটো অলিম্পিক থেকে। কিন্তু একই অলিম্পিকে দু-দুটো পদক? ১২৪ বছরের ইতিহাসে মাত্র দু’জন ভারতীয় পেয়েছেন। দ্বিতীয় জন মনু ভাকের? স্বাধীন ভারতের প্রথম অ্যাথলিট, যিনি একই অলিম্পিকে দুটো পদক এনে চমকে দিলেন। আর প্রথম জন কে? নর্ম্যান গিলবার্ট প্রিচার্ড। যিনি পরিচিত ছিলেন নর্ম্যান প্রিচার্ড নামে। ১২৪ বছর আগে ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকে দুটো পদক জিতেছিলেন তিনি। সেই প্রথম অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব। আর প্রথম বারই স্রেফ পদক নয়, দুটো রুপো এনেছিলেন নর্ম্যান। ২০০ মিটার হার্ডলস ও ২০০ মিটার রেস থেকে। মনুর সাফল্য আবার আলোচনায় ফিরিয়ে এনেছে তাঁকে। কে এই নর্ম্যান প্রিচার্ড?
১৮৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল এই খাস কলকাতার আলিপুরে জন্ম নর্ম্যানের। বাবা জর্জ পিটারসন প্রিচার্ড ছিলেন কেরানি। মা হেলেন মেনার্ড প্রিচার্ড। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হন নর্ম্যান। ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলোর প্রতি টান। ফুটবল খেলতেন চমৎকার। আর ছিলেন অ্যাথলিট। বিশেষ করে স্প্রিন্টার হিসেবে বেশ নাকডাক ছিল তাঁর। ১৯৮৪ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত টানা বেঙ্গল ১০০ ইয়ার্ডসে একাধিক রেকর্ড করেছেন। বারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো স্প্রিন্টারই ছিল না সে সময়। আসলে জন্ম থেকেই বিশ্বমানের অ্যাথলিট ছিলেন নর্ম্যান প্রিচার্ড। পড়াশোনা শেষ করে নামী ট্রেডিং কোম্পানি বার্ড অ্যান্ড কোংয়ে চাকরি পান। কিন্তু ফুটবল বা স্প্রিন্ট কোনওটাই ছাড়েননি তিনি।
১৯০০ সালে, ২৫ বছর বয়সে বাবা জর্জের সঙ্গে ইংল্যান্ড যান নর্ম্যান। সেখানে দিয়ে ট্রিপল এ চ্যাম্পিয়নশিপে নামেন নর্ম্যান। সেখানে চমকে দেওয়া পারফর্ম করেন। কিন্তু এখানেই টুইস্ট এবং বিতর্ক। ট্রিপল এ চ্যাম্পিয়নশিপের ১১০ মিটার হার্ডলসে দুরন্ত পারফরম্যান্সের জন্য ব্রিটিশ অলিম্পিক টিমে সুযোগ পেয়ে যান। প্যারিস অলিম্পিকেও নামেন। তা হলে ভারতীয় অ্যাথলিট হলেন কী ভাবে? ভূমিপুত্র হিসেবে তিনি ভারতীয়ই। এমনও একটা গল্প চালু আছে, প্যারিস অলিম্পিকে নামার আগে তিনি নাকি বলেছিলেন, যে দেশে জন্মেছেন, অর্থাৎ ভারতের হয়েই অলিম্পিকে নামতে চান তিনি। এই কাহিনি কতটা সত্য, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ নর্ম্যানকে নিয়ে পরের ১২০ বছর ধরে কখনও ইংল্যান্ড আবার কখনও ভারত নিজের দেশের অ্যাথলিট বলে দাবি করে এসেছে।
এক অলিম্পিক ঐতিহাসিক ইয়ান বুকানান এ নিয়ে দীর্ঘ রিসার্চ করেছেন। তাঁর কথা মতো, নর্ম্যান প্রিচার্ডের পরিবার যে গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সে যতই ভারতে জন্মান নর্ম্যান, তাঁকে গ্রেট ব্রিটেনের নাগরিক বলেই ধরা হয়েছে। ঠিক এই কারণেই নর্ম্যানকে ভারতের নাগরিক ধরা হয়। ঘটনা হল, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অ্যাথলেটিক ক্লাবের পাশাপাশি লন্ডন অ্যাথলেটিক ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন নর্ম্যান। বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি কিন্তু নর্ম্যান প্রিচার্ডকে ভারতের অ্যাথলিট হিসেবেই মেনে নিয়েছে।
প্যারিস অলিম্পিকের পর কিন্তু ভারতেই ফিরে আসেন নর্ম্যান। তবে আর অ্যাথলিট বা প্লেয়ার হিসেবে দেখা যায়নি, হয়ে ওঠেন প্রশাসক। ১৯০০ সাল থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত পাঁচ বছর নর্ম্যান ছিলেন আইএফএর সচিব। ততদিনের অভিনয়ের শখও চেপেছে মাথায়। অভিনেতা স্যার চার্লস উইড্যাম পাশেও দাঁড়ান। ধীরে ধীরে থিয়েটারের দুনিয়ায় পা বাড়ান। তার কিছু দিনের মধ্যেই চলে যান আমেরিকায়। নির্বাক সিনেমায় ট্রেভর প্রিচার্ড হিসেবে অভিনয়ও শুরু করেন। ২৬টা নায়ক ও ২৭টা সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তবে খুব বেশি দিন তা সম্ভব হয়নি। মস্তিষ্কের রোগের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯২৯ সালের ৩০ অক্টোবর মারা যান নর্ম্যান প্রিচার্ড।