কমলেশ চৌধুরী
বাজারে আলুর দাম কত জানেন? জ্যোতি হলে এক কিলো আলুর দাম (Potato Price) ২০ টাকার বেশি। আর চন্দ্রমুখী? অন্তত ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা। কেন এত দাম (Global Warming)? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক’দিন আগে নিজেই উত্তরটা দিয়েছেন, এ বার উত্পাদন ২৫% কম। আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, উত্পাদন কম হল কেন? উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে শীতের শুরুতে। মনে আছে নিশ্চয়ই সে সময় বারবার বৃষ্টির কথা। ডিসেম্বরের শুরুতে বঙ্গোপসাগরে হাজির ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ। ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় না, এমন নয়। কিন্তু অভিমুখ থাকে মূলত তামিলনাড়ুর দিকে। ছক ভেঙে জাওয়াদ এগোতে শুরু করে বাংলার দিকে। উদ্বেগ খানিকটা কমে, যখন সাগরেই দুর্বল হয় জাওয়াদ। যদিও ঘূর্ণিঝড় তকমা হারালেও, নিম্নচাপের প্রভাবেই টানা বৃষ্টি জেলায়-জেলায়। কত বৃষ্টি হয়েছিল জানেন? কলকাতার হিসেব, ৯ দিনে ৯৬ মিলিমিটার। ১৯৮১ সালের পর ডিসেম্বরে এত বৃষ্টি কখনও হয়নি আলিপুরে।
আলুতে ফেরা যাক। ধানচাষের শুরুতে জমিতে জল থাকতে হয়। না-হলে চাষের ক্ষতি। আলুতে উল্টো। ঝুরঝুরে হতে হয় মাটি। কিন্তু দিনকয়েকে ভারী বৃষ্টি হলে ঝুরঝুরে মাটি মিলবে কী ভাবে? শুধু তো জাওয়াদের জন্য নয়, নভেম্বরেও দফায়-দফায় বৃষ্টি হয়েছে। ফলে শুরুতে যে চাষিরা আলুর বীজ ছড়িয়েছিলেন, বৃষ্টিতে সব নষ্ট। আবার বীজ ফেলে চাষের চেষ্টা। কিন্তু যতদিনে মাটি শুকনো হল, ততদিনে অনেকটা সময় পার। দেরির মাসুল কীভাবে গুনতে হল? ফলন তোলার আগেই, ফেব্রুয়ারিতে হঠাত্ তাপমাত্রা চড়া শুরু। ওই গরমে আর যা-ই হোক, আলুচাষ হয় না। ধরল ধসা রোগও। মোদ্দা কথা, পরের পর ‘দোষ’ আলুর। ফল? উত্পাদন কম। মানে বাজারে জোগান কম। আর দাম? আকাশছোঁয়া।
আবহবিদদের একাংশ বলছেন, এই যে আলুচাষে ক্ষতি, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ছায়া নেহাত কম নয়। ছকভাঙা ঘূর্ণিঝড়, তার পর পশ্চিমী ঝঞ্ঝার ঠেলায় শীতে বারবার বৃষ্টি, ফেব্রুয়ারিতে হঠাত্ই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া—আবহাওয়া এত খামখেয়ালিপনা দেখাবে কেন! দেখাবে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা।
ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চে আসা যাক। খামখেয়ালিপনা আরও ভাল করে বোঝা যাবে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে রেকর্ড বৃষ্টি। পাহাড়ে রেকর্ড তুষারপাত। মার্চে সেই বৃষ্টিই উধাও। ১১ মার্চ থেকে তাপপ্রবাহের দাপট শুরু। যা বৃষ্টি হওয়ার কথা, তার ৭১ শতাংশ বৃষ্টিই হয়নি। উত্তর-পশ্চিম ভারত বা মধ্য ভারতে ঘাটতি আরও বেশি। সেই সুযোগে রাজ্যে-রাজ্যে তাপপ্রবাহ, তীব্র তাপপ্রবাহ। মাস শেষ হতে দেখা গেল, বাইশের মার্চ ১২২ বছরের মধ্যে উষ্ণতম। রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ তাপপ্রবাহ দেখতে, সহ্য করতে অভ্যস্ত। কিন্তু তাই বলে মার্চ থেকেই! এরকমটা সচরাচর হয় না। তা-ও আবার লম্বা মেয়াদে!
এই দহনকে কি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জোড়া যায়? দিব্যি জোড়া যায়। আবহবিদরা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কয়েকটা উদাহরণ টানছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের আইপিসিসি প্রতিটি রিপোর্টেই নিয়ম করে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তন মানে এক্সট্রিম ওয়েদার ইভেন্ট অর্থাত্ আবহাওয়ার চরম ধরনের ঘটনার সংখ্যা বাড়বে। অর্থাত্, দু’টো চরম ঘটনার মধ্যে সময়ের ফারাক কমে আসবে। মার্চের গরমেও সেই ধারা। যেমন, সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় দেখলে ২০২২ যদি শীর্ষে থাকে, ২০১০ তাহলে দ্বিতীয়। তৃতীয় ২০০৪। চতুর্থ ২০২১। পঞ্চম সালটা কবে? ১৯৭৭। যে বছর বাংলায় বামেরা ক্ষমতায় এল, সে বছর! তালিকার প্রথম চারকে দেখলে বোঝাই যাচ্ছে, হাল আমলে ‘মেমোরিজ অফ মার্চ’ কতটা দুঃসহ!
মার্চ পেরিয়ে এ বার একটু এপ্রিলেও তাকানো যাক। বৃষ্টির ব্যাডপ্যাচ এখনও চলছে। দেশের মধ্যে বৃষ্টি শুধু উত্তর-পূর্ব ভারত আর দক্ষিণ ভারতে। মাঝের বিস্তীর্ণ তল্লাটে খেলা দেখাচ্ছে তাপপ্রবাহ। মাঝ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলা অনেকটা গা বাঁচিয়ে খেলছিল। বৈশাখের শুরুতে সেখানেও তাপপ্রবাহের হানা। ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চৌকাঠে পৌঁছেছে বাঁকুড়ার তাপমাত্রা। দমদম, ব্যারাকপুরের মতো জায়গায় অর্থাত্, কলকাতার একেবারে দোরগোড়ায় পরপর দু’দিন তাপপ্রবাহ। আর চল্লিশের চৌকাঠে আলিপুর। কোথাও তাপ আর কোথাও ভ্যাপসা গরমে অস্থির মানুষ। এপ্রিল শেষের পথে, তবু দক্ষিণবঙ্গে কালবৈশাখীর ভাঁড়ার শূন্য। ২৮ ফেব্রুয়ারির পর বৃষ্টির ছোঁয়া পায়নি কলকাতা।
এখানেও কি জলবায়ু পরিবর্তনকে টানা যায়? আবহবিদদের একাংশ বলছেন, আলবাত যায়। আইপিসিসি বারবার বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বড় প্রভাব বৃষ্টির উপর পড়ছে। শুকনো দিনের মেয়াদ বাড়ছে। অর্থাত্, একটানা অনেক দিন বৃষ্টি নেই। ঠিক গত দেড় মাস ধরে যার সাক্ষী দেশ এবং বাংলার একটা বড় অংশ। আর বৃষ্টি যখন হচ্ছে, তখন ঢেলে হচ্ছে। অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি। গত বর্ষায় যার সাক্ষী মহারাষ্ট্রের মহাবালেশ্বর থেকে বাংলার আসানসোল। মহাবালেশ্বরে দু’দিনে ১০৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল, একদিনে ৪৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল আসানসোলে। যা দেখে শিল্পশহরের প্রবীণরাও বলেছিলেন, এমন লক্ষ্মীছাড়া বৃষ্টি কোনওদিন দেখেননি তাঁরা।
তাহলে কী দাঁড়াল? আইপিসিসি রিপোর্টে যা লিখছে, ঠিক তাই ঘটছে। আর শুধু চিন বা ব্রাজিল বা অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, ঘটছে আমাদের ঘরেই। দুয়ারে গ্লোবাল ওয়ার্মিং!
অত্যুক্তি কী? মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, উপ-মহানির্দেশক সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় TV9 বাংলাকে কী বলেছেন শুনুন। তিনি বলছেন, ‘‘এতদিন আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দুনিয়ার কথা ভেবেছি। কিন্তু এখন যা দেখছি, তাতে বলতে হয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং আমাদের দরজায় এসেও ধাক্কা দিচ্ছে। মার্চে উত্তর-পশ্চিমে ভারতে যে গরম পড়েছে, তা বছর বছর দেখা যায় না। আবার মার্চেই বঙ্গোপসাগরে দু’দুটো অতি গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে, এরকমটাও বিশেষ দেখা যায়নি। এতদিনে দক্ষিণবঙ্গে একটাও কালবৈশাখীর দেখা মেলেনি। দেখা পাওয়া দূর, ছোটনাগপুর মালভূমির দিক থেকে বজ্রগর্ভ মেঘ কলকাতা পর্যন্ত আসার অনুকূল পরিস্থিতি পর্যন্ত তৈরি হয়নি।’’
অথচ, উত্তরবঙ্গে টানা বৃষ্টি চলছে। বলা যায়, বৃষ্টিতে বঙ্গ-ভঙ্গ! অথচ দু’টোতেই ক্ষতি। দক্ষিণবঙ্গের চাষি বৃষ্টি না পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে, উত্তরের চাষি অতিবৃষ্টিতে বিপদে। শুধু আলু নয়, সব চাষেই জলবায়ু পরিবর্তনের কুনজর। গত বছর বর্ষা আর অঘ্রাণের অতিবৃষ্টিতে ধানের যা ক্ষতি হয়েছে, চালের দামে এখনও তার মাসুল গুনছে মানুষ। মাসখানেক পেরোলে আবার বর্ষা। স্বাভাবিক বৃষ্টির পূর্বাভাস দেশে। কিন্তু সব জায়গায় কি বণ্টন ঠিকভাবে হবে? বর্ষার সময়ে আসা, সময়ে বৃষ্টি দেওয়া-না দেওয়ার উপরও বাজারের দামটা নির্ভর করছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং মানে শুধুই গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলবে এমন নয়, গোসাবাতেও তার প্রভাব পড়বে। খাদ্যশৃঙ্খলের মতো দুনিয়াজুড়ে হাওয়া-বাতাসের শৃঙ্খলও কাজ করে। এক জায়গায় শৃঙ্খলাভঙ্গ হলে শাস্তি সবার।
দুয়ারে প্রকৃতির রোষ। পালাবার পথ নেই।
গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভীক দেবনাথ