বাঁকুড়া: প্রাথমিক স্কুলের পর এবার কোপ পড়তে চলেছে বাঁকুড়া জেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলির উপর। ইতিমধ্যেই বাঁকুড়া জেলার সাতটি ব্লকে মোট সাতটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র বন্ধের নোটিশ দিয়েছে প্রশাসন। কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে ওই স্কুলগুলিতে পড়ুয়ার সংখ্যা নেমে এসেছে ২০-র নীচে। স্কুল বন্ধের নোটিস মিলতেই চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে পড়ুয়াদের। চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবক থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু একসময় রমরমিয়ে চলা এই মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলির এমন হাল কেন? কোন পরিস্থিতিতে পড়ুয়ার সংখ্যার নামল এতটা নীচে?
রাজ্যের যে সমস্ত এলাকা থেকে প্রাথমিক ও হাইস্কুলের দূরত্ব বেশি সেই সমস্ত এলাকার পড়ুয়াদের জন্য ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা হয়। মূলত রাজ্যের স্কুলছুট পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করাই ছিল এই শিক্ষা কেন্দ্রগুলির উদ্দেশ্য। বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষা কেন্দ্রগুলি খোলার পাশাপাশি তৈরি হয় স্কুলগুলির নিজস্ব পরিকাঠামো। সরকারি উদ্যোগে চুক্তির ভিত্তিতে স্কুলগুলিতে নিযুক্ত হয় যথেষ্ট শিক্ষকও। ঘরের কাছে স্কুল মেলায় প্রথম দিকে প্রতিটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রেই পড়ুয়ার ভিড় জমতে শুরু করে।
কিন্তু কেন হঠাৎ এভাবে একটি জেলাতেই এক সঙ্গে মোট ৭ টি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধের নোটিস দিতে হল প্রশাসনকে? সম্প্রতি বাঁকুড়া জেলায় বন্ধের নোটিস পাওয়া একটি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের ইতিহাস দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
২০০৪ সালে একটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র পথচলা শুরু করেছিল বাঁকুড়া এক নম্বর ব্লকের কুমিদ্যা গ্রামে। কুমিদ্যা রাধামাধব মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র নামের সেই স্কুলে চার জন শিক্ষক নিযুক্ত ছিলেন। তৈরি হয়েছিল স্কুলের নিজস্ব বিশাল ভবন। চালু হয়েছিল মিড ডে মিলও। স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একসময় তা ২১০-এ পৌঁছে যায়। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে দুজন শিক্ষক অবসর নেওয়ায় এবং ২০১১ সালের পর মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। ওই শিক্ষাকেন্দ্রে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৪ টি ক্লাসের পড়ুয়াদের পড়ানোর যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে অবশিষ্ট দুই শিক্ষকের।
একজন শিক্ষক কোনওরকমে বাংলা ও ইংরাজি বিষয় পড়ান, অপরজন কোনওক্রমে সামাল দেন অঙ্ক ও বিজ্ঞান বিষয়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়াদের একটি ক্লাসরুমে এবং সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের অপর একটি ক্লাসরুমে একসঙ্গে বসিয়ে শিক্ষাকেন্দ্রে কোনওক্রমে পঠন পাঠন অব্যাহত রাখেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে নামতে শুরু করে স্কুলের পঠন পাঠনের মান। অগত্যা বহু অভিভাবক মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র থেকে ছাড়িয়ে পড়ুয়াদের দূরবর্তী স্কুলে ভর্তি করেন।
অনেকে হতাশায় মাঝপথেই লেখাপড়ায় ইতি টেনে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পড়ে। ফলে দ্রুত হারে নামতে শুরু করে পড়ুয়ার সংখ্যা। বর্তমানে ওই স্কুলে ৪ টি ক্লাস মিলিয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা মাত্র ১৯ জন। স্থানীয় অভিভাবক থেকে শিক্ষকদের দাবি, প্রথমে সরকারি অবহেলার কারণে স্কুল পড়ুয়ার সংখ্যা এত কমেছে। আর এখন পড়ুয়ার সংখ্যা কম থাকার কারণ দেখিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষাকেন্দ্রটিকেই। এভাবে হঠাৎ করে শিক্ষাকেন্দ্রটি বন্ধের নোটিস মেলায় হতাশার সুর পড়ুয়া থেকে শুরু করে শিক্ষক এমনকি অভিভাবকদের গলাতেও। মন খারাপ পড়ুয়াদের।
এক ছাত্রী বলল, “মনটা ভেঙে পড়েছে। এখানে ছোট থেকে পড়ছি। এখন অনেক দূর স্কুল যেতে হবে। বাড়ির লোক নাও যেতে দিতেও পারে। মেইন রোড ক্রস করে যেতে হবে তো অনেকটাই। এখন বাড়ির লোক নাও ছাড়তে পারে। পড়াশোনাটা বন্ধ হয়ে যাবে। গরিব বাড়ির ছেলেমেয়ে তো, বাড়ির কাছে স্কুল বলে রোজ আসতাম।” বলতে গিয়ে মেয়েটা কেঁদেই ফেলে।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “সরকারি অর্ডার যেটা এসেছে, আমি দেখেছি, সেখানে বলা হচ্ছে, যদি ২০-র নীচে ছাত্রসংখ্যা হয়, তাহলে স্কুল তুলে দেওয়া হবে। পোর্টালে আমাদের স্কুলের ছাত্রসংখ্যা নথিভুক্ত ১৮। কিন্তু বাংলা শিক্ষা পোর্টালে আমার স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ২১। শিক্ষক কম। পড়াশোনা ঠিকভাবে হয় না। একজন আর্টস, একজন সায়েন্সের। স্কুলটাকে কোনওরকমে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম।”
কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগ করেই যেখানে শিক্ষাকেন্দ্রটির হাল ফেরানো যেতে সেখানে শিক্ষাকেন্দ্রটিকেই তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কেন্দ্রের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীও এই ঘটনার জন্য কড়া সমালোচনা করেছে রাজ্য সরকারের।
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার বলেন, “বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা যা হয়েছে, বাঁকুড়ায় ৭ টা স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। না শিক্ষক নিয়োগ, পরিকাঠামো খারাপ, ছাত্রছাত্রীরা সরকারি স্কুল থেকে বেসরকারি স্কুলে চলে যাচ্ছে। বহু স্কুলছুট হচ্ছে, ড্রপ আউট বাড়ছে, কারণ রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।”