‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা…’ -ছোট থেকেই ভ্রমণপিপাসু তিতলি। বলা যায়, যেমন নাম, তেমনই স্বভাব। যেন ওর জন্য একেবারে পারফেক্ট এই নাম। আজ তিতলি বড় হয়েছে। কলেজ পাশ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। কিন্তু, যখন ছোট ছিল, স্কুলে পড়ত, তখন থেকেই ঘোরা-বেড়ানোর নাম শুনলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেত। শনিবার মাস্টারমশাই পড়াতে আসতেন না। তাই স্কুল ছুটি ছুটির পর বাড়ি ফিরেই তাকে নিয়ে বেরোতে হবে। কোথাও না হলে পিসতুতো দাদার সঙ্গে চলে যেত পিসির বাড়ি। আবার সোমবার সকালে ফিরে স্কুল করত। ঘোরা-বেরানোর জন্য যেন এতটুকু ক্লান্তি নেই। আজ সেই ছোট্ট তিতলি অনেক বড় হয়েছে। এক নামি MNC কোম্পানিতে চাকরি করছে। তবু তার ঘোরার নেশা কাটেনি। আজও দু-তিন মাস ছাড়াই যেভাবেই হোক অন্তত ২-৩ দিনের ছুটি ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়ে। আজ আর বেড়াতে যাওয়ার জন্য তিতলির কাউকে লাগে না। বন্ধু বা পরিবারের কেউ সঙ্গে গেলে ভাল, নয়তো নিজেই ব্যাগ গুছিয়ে, ট্রেনের তৎকাল টিকিট কেটে বেরিয়ে পড়ে। আসলে, সোলো ট্রাভেলার হতে চায় তিতলি। তবে এবার কেদারনাথ ট্রেকিংয়ে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হল…
কেদারনাথ দর্শন করে ফিরছি। একটা দোকানে চা খেতে দাঁড়িয়েছি। আশপাশে আরও কতকগুলো দোকান-হোটেল, ধাবা রয়েছে। আমার মতো অনেকেই এই সব দোকানে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। হঠাৎ করেই মুষলধারায় বৃষ্টি নামল। সকলেই মাথা বাঁচাতে দোকানের ছাউনির ভিতর ঢুকে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সবাই ভেবেছিলাম, কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি থেমে যাবে। কিন্তু, এ কী হল! দূর থেকে সেনাদের চিৎকার, সব লেট যাও (সকলে শুয়ে পড়)। দোকানদারও বললেন, উপুড় হয়ে সকলে মাটিতে শুয়ে পড়ুন। বিস্ময়, আতঙ্কে তিতলির মুখেও কথা সরল না। দোকানদারের নির্দেশ মতো সকলের সঙ্গে তিতলিও দোকানের সামনে মাটি আঁকড়ে ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। তিরের মতো শরীরের উপর এসে বিঁধছে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। আর কি উঠতে পারব? আর কি বাড়ি ফিরতে পারব? মাটিতে মুখ গুঁজে এমনই ভাবছে আর হরিনাম জপছে সকলে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী তিতলিরও সব রোমাঞ্চ উবে গিয়েছে। হয়তো একেই বলে মৃত্যুভয়। এভাবে ১০-১৫ মিনিট কাটার পর ফের কানে এল, সব উঠ যাও (সবাই উঠে পড়)।
সম্বিৎ ফিরল তিতলি-সহ সকলের। তাহলে সব ঠিক আছে। বৃষ্টি থেমেছে। মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সকলে। কিন্তু, এ কী! আশপাশের দোকান দুটি কোথায় গেল। এটা রাস্তা নাকি নদী? সকলের একই প্রশ্ন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাস্তা নদীতে পরিণত হয়েছে। জলের কী স্রোত! এটা নদী নাকি রাস্তা কে বুঝবে!…নাগাড়ে বলে চলেছে তিতলি। দোকানদারের কাছে অবশ্য এই ছবি খুব একটা অচেনা নয়। তারাই জানান, এটা সাধারণ বৃষ্টি নয়, মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। খবরে, গল্পে মেঘ ভাঙা বৃষ্টির কথা শুনেছে তিতলি। কিন্তু, নিজের চোখে আগে দেখেনি। দোকানদার হিন্দিতে জানালেন, পাশের ধাবাটি ভেসে গিয়েছে। সেনাদের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। জানা গেল, ওই ধাবায় দাঁড়িয়ে থাকা এক পর্যটকও ভেসে গিয়েছে জলের স্রোতে। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে আরেকজনও ভেসে যাচ্ছে। চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে অকুতোভয় তিতলিরও পায়ের তলায় মাটি সরে যায়। তারপর সেনাবাহিনীর তৎপরতায় নিরাপদ স্থানে ফিরে আসে তিতলি ও তার মতো আটকে পড়া পর্যটকেরা। কিন্তু, ভেসে যাওয়া ওই পর্যটকদের কী হল? ওরা কি ভেসে গেল নাকি উদ্ধার হয়েছে? জবাব মেলেনি।
কেদারনাথের এই ঘটনা অবশ্য প্রথম নয়। ২০১৩ সালে এভাবেই মেঘ ভাঙা বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল কেদারনাথে। এবারে অবশ্য বড় বিপদ ঘটেনি। তবে কেদারে বড় বিপদ না ঘটলেও হিমাচল থেকে কেরলের ওয়ানাড়ে একের পর এক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। হিমাচল প্রদেশের মাণ্ডি থেকে সিমলার কাছে রামপুরে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি ও ভূমিধসে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ধস ও জলের তোড়ে বহু মানুষ ভেসে গিয়েছে। ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ।
উত্তরের মতো বৃষ্টি আর ভূমিধসে বিধ্বস্ত দক্ষিণের রাজ্যও। ঈশ্বরের আপন দেশ কেরলের ওয়ানাড় জেলার অবস্থা খুবই সঙ্গীণ। একেবারে রাতারাতি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে ৩টি গ্রাম। কয়েকশো মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
উত্তর থেকে দক্ষিণে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ একটাই, মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। ওয়েনাড়ের বিপর্যয়ের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে আরব সাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি। কোচি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অ্যাডভান্সড সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রাডার রিসার্চের ডিরেক্টর, এস. অভিলাশ জানিয়েছেন, আরব সাগরে হঠাৎ করে উষ্ণতা বৃদ্ধি বায়ুমণ্ডলে গভীর মেঘ তৈরি করেছিল। যা অল্প সময়ের মধ্যে কেরলজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত হয় এবং ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। কেরলে এরকম একটা বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে কয়েক বছর আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিল দিল্লি আইআইটি। এই ধরনের ঘটনার পিছনে রয়েছে অপরিকল্পিতভাবে বহুতল নির্মাণ, যথেচ্ছভাবে গাছ কাটা। তাহলে এরকম ঘটনা উত্তরবঙ্গেও ঘটতে পারে? এমনই আতঙ্কের মেঘ উঁকি দিচ্ছে।
তিতলির আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। আগামী ১০ বছরের মধ্যে দার্জিলিঙের অবস্থাও হিমাচল বা উত্তরাখণ্ডের মতো হতে পারে বলে আশঙ্কার বাণী শোনালেন বিশিষ্ট পরিবেশবিদ তথা দক্ষিণ দমদমের কাউন্সিলার ড. অঞ্জন সিনহা। আর এর নেপথ্যে অবশ্যই মানুষের ভাল থাকার চাহিদা।
পরিবেশবিদ ড. অঞ্জন সিনহা জানান, তিস্তা নদীর গতিপথে সিকিম থেকে মেখলিগঞ্জের মধ্যে ৪টি বাঁধ হয়েছে। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়েছে। বর্ষায় নদীতে বেশি জল এলে বাঁধের নিকাশি ঠিক থাকে না। তার ফলে বাঁধ উপচে জল চলে আসে সমতলে। নিকাশি ঠিক থাকলে এটা হত না, এটা খরচসাপেক্ষ। আর বাঁধের প্রধান কারণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। নদীর স্বচ্ছন্দ গতিকে প্রতিহত করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা আর পাহাড়ে যাতায়াতের সুবিধা করা ও ট্যুরিজমের জন্য নেওয়া উদ্যোগে বিপদ বাড়ে।
হিমাচল প্রদেশ থেকে উত্তরাখণ্ডে ভূমিধসের অন্যতম কারণ, এই রাজ্যগুলি হিমালয়ের কোলে অবস্থিত। আর হিমালয় হল নবীন ভঙ্গিল পর্বত। অর্থাৎ এটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ভূ-পৃষ্ঠের নীচে ক্রমাগত শিলার বদল ঘটছে। এর উপর যদি উঁচু-উঁচু হোটেল, বাড়ি গজায়, রাস্তা তৈরির জন্য ক্রমাগত পাহাড় কাটা হয়, তাহলে শিলা বিচ্যুতি তো হবেই। ড. সিনহার কথায়, “চারধাম যুক্ত করার রাস্তা হোক বা দার্জিলিঙে পাহাড়ে সুড়ঙ্গ কেটে রেললাইন- এগুলি ম্যানমেড ইন হ্যাজার্ডস। হিমালয় অস্থির ও স্পর্শকাতর পাহাড়। পাহাড়ের শিলা নতুন। ফলে হিমাচল হোক বা দার্জিলিঙের ধস- এগুলি প্রকৃতির প্রতিশোধ। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যেই হিমাচল, উত্তরাখণ্ডের মতো দার্জিলিঙে বিপর্যয় হতে পারে।”
ড. সিনহার মতো একই মত বিজেপি নেতা তথা পরিবেশকর্মী ও মানবাধিকার কর্মী ড. মোহিত রায়ের। তিনি জানান, উত্তরাখণ্ড, হিমাচবের মতোই আমাদের দার্জিলিং বা উত্তর-পূর্বাঞ্চল হিমালয়ের উপর অবস্থিত। আর হিমালয় হল নতুন পর্বতমালা। এটি এখনও তৈরি হচ্ছে। ফলে এটা এখনও ভঙ্গুর। তাই উত্তরাখণ্ড, হিমাচলের মতো বৃষ্টি হলে ধস বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হিমালয়ের প্রকৃতিও একই রকম। এই অঞ্চলে আবার বৃষ্টিপাত বেশি হয়। ফলে বিপদের ঝুঁকি বেশি। উত্তরাখণ্ড বা হিমাচল পর্যটনের জন্য অনেকদিন ধরে লোকজন যান, অনেক তীর্থস্থান রয়েছে, সেজন্য অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে, যাতায়াত বেড়েছে, অনেক হোটেল বেড়েছে। আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এতটা হয়নি। কিন্তু, যখনই আমাদের এখানে আরও বেশি পাহাড়ে নগরায়ন হবে, আরও বেশি উন্নয়নের কাজ হবে, তখন এই আশঙ্কাগুলি আরও বাড়বে।
উত্তরবঙ্গ বিপর্যয় যে দেখেনি, তা তো নয়। কেরলের ওয়ানাড়ের মতোই ২০১৫ সালে এক রাতের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিল মিরিকের টিংলিং গ্রাম। পরে সূর্যের আলো ফুটলে কাদার নীচে থেকে উদ্ধার হয় দেহের সারি। সরকারি মতে মৃতের সংখ্যাটা ছিল ৩০। তবে বেসরকারি মতে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়। সেই ঘটনার পরেও যে কারও শিক্ষা হয়নি, তা দার্জিলিঙের বর্তমান অবস্থা এবং তিস্তা লাগোয়া ১০ নম্বর জাতীয় সড়কে একের পর এক ভূমিধসের ঘটনাতেই স্পষ্ট।
ড. সিনহা জানান, ভারতের ৫৮.৬ শতাংশ ভূমি ভূকম্প-প্রবণ। উত্তরবঙ্গ ও সংলগ্ন এলাকার মধ্যে অতিরিক্ত ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চল হল, উত্তর সিকিম। সিসমিক স্কেল অনুযায়ী, এই এলাকা মাঝারি মানের ভূকম্প-প্রবণ অঞ্চল। অথচ সেখানেই এখন একাধিক হোটেল, হোম স্টে গড়ে উঠেছে। তারই ফল গত বছরের হ্রদ বিস্ফোরিত হয়ে বন্যা বলে মনে করেন তিনি। তবে নগরায়ন, উন্নয়নের কাজ বন্ধ করলে চলবে না বলেই মনে করেন ড. মোহিত রায়। তাঁর মতে, “নগরায়নের কাজ বন্ধ করলে চলবে না। আজকাল বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে হিমালয় নিয়ে চর্চা করার একাধিক কেন্দ্র রয়েছে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ভাবে নগরায়নের কাজ করতে হবে।” এপ্রসঙ্গে চিনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ চিনে এই হিমালয়ের একটা বড় অংশ রয়েছে। কিন্তু, তারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক রাস্তাঘাট, রেললাইন করেছে। সুতরাং আমরা ভয় পেয়ে কিছু করব না এটা ঠিক নয়। আমাদেরও যোগাযোগের জন্য রেললাইন, রাস্তা করতে হবে। কিন্তু, উন্নত প্রযুক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে, অবশ্যই পরিবেশবান্ধবভাবে কাজ করতে হবে।”
বর্তমানে নগরায়নের কাজ হলেও পরিবেশের দিকটা গুরুত্ব পায় না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন ড. অঞ্জন সিনহা। তাঁর কথায়, “পাহাড়ে যাতায়াতের সুবিধা ও ট্যুরিজমের জন্য এগুলির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু, এসবের মধ্যে পরিবেশের দিকটা গুরুত্ব পায় না। ৫ জুন পরিবেশ দিবস পালিত হয়। অনেক অঙ্গীকার নেওয়া হয়। কিন্তু, সেগুলি কেবল আলোচনা টেবিলেই সীমাবদ্ধ থাকে।” এপ্রসঙ্গে রাজনীতিক তথা পরিবেশকর্মী ড. মোহিত রায়ের মন্তব্য, “আজকাল তাড়াতাড়ি কোনও কাজ করে দিয়ে সাফল্য নেওয়ার চেষ্টা হয়। সেটা না করে পরিবেশবান্ধব ভাবে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে করতে হবে।” না হলে উত্তরাখণ্ড, হিমাচলের মতো দার্জিলিঙের পরিণতি হওয়ার আশঙ্কা খুবই বাস্তব বলে মনে করেন তিনি।
কেবল পাহাড় নয়, উপকূলবর্তী এলাকাও বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে সতর্কবার্তা দেন কাউন্সিলার তথা পরিবেশবিদ ড. অঞ্জন সিনহা। কলকাতা, হাওড়া-সহ বিভিন্ন শহর যেভাবে বৃষ্টিতে প্লাবিত হচ্ছে, সেটাও কার্যত বিপদ সংকেত। পরবর্তীতে কলকাতা জলের তলায় চলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। এছাড়া সামগ্রিকভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে যেভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ২০৫ সালের মধ্যে কলকাতার তাপমাত্রা ৫০-৫১ ডিগ্রি হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।