হুগলি: সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা সন্তানদের কোথায় পড়ান? মিলল চাঞ্চল্যকর সব উত্তর

Hooghly: স্কুল শিক্ষা দফতরের নির্দেশ অনুযায়ী, পরীক্ষার সময় ছাত্ররা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেই নম্বর দিতে বাধ্য শিক্ষকরা। ফলে মূল্যায়ণ পদ্ধতি শিকেয়।

হুগলি: সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা সন্তানদের কোথায় পড়ান? মিলল চাঞ্চল্যকর সব উত্তর
সরকারি শিক্ষকদের সন্তান আদৌ সরকারি স্কুলে পড়ে?
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Apr 07, 2023 | 9:46 PM

আরামবাগ: শিক্ষক আছে। ছাত্র নেই। কোথাও ছাত্র আছে। শিক্ষক নেই। কোথাও আবার ছাত্র-শিক্ষক কেউ নেই। আছে শুধু ব্ল্যাকবোর্ড চেয়ার টেবিল। এমন অভিযোগ প্রায়শই উঠেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভুয়ো শিক্ষক। যেন ঠগ বাছতে গাঁ উজার। এ সব কারণেই সরকারি স্কুলে (Government School) সন্তানদের পড়াতে ভরসা পাচ্ছেন না বলে অনেকের মুখে অনুযোগ শোনা গিয়েছে। কিন্তু যাঁরা সরকারি স্কুলে পড়ান, সরকারি পরিকাঠামোয় ছাত্র-ছাত্রীদের গড়ে পিঠে মানুষ করে তোলেন, যাঁদের ছাত্র পড়ানোই একমাত্র পেশা, তাঁরা অর্থাৎ সরকারি শিক্ষকরা এ নিয়ে কী ভাবছেন? নিজেদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে কী মত তাঁদের? এই সব প্রশ্ন খুঁজতে TV9 বাংলা হুগলি জেলার কয়েকটি স্কুলে ঢুঁ মারে। কথা বলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে। চাঞ্চল্যকর চিত্র উঠে আসে তাঁদের কথোপকথনে।

হুগলির গোঘাট। সেখানকার একটি নামকরা সরকারি স্কুলে ৩০ জন শিক্ষিক-শিক্ষিকা। অশিক্ষক কর্মী ২ জন ও গ্রুপ ডি ৩ জন। সকলেই সরকারি কর্মী। এই স্কুলের ৩০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে ৮ জনের ছেলেমেয়ে বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করছে। বাকি শিক্ষকদের মধ্যে কারও কারও সন্তান অবশ্য স্কুলের গণ্ডি পার করেছে। তবে অধিকাংশেরই সেক্ষেত্রে বেসরকারি স্কুল থেকে পাশ করে সরকারি কলেজে পড়াশোনা চলছে। আবার কয়েকজন শিক্ষক এখনও বিয়ে করেননি কিংবা তাঁদের সন্তান ছোট। এই স্কুলেরই অশিক্ষক এক কর্মীর দুই সন্তান। প্রথম সন্তান সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। তবে পরের যে সন্তান, তাকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেছেন বাবা।

শুধু এই স্কুল নয়। আরামবাগের বেশ কয়েকটি সরকারি স্কুলে যোগাযোগ করা হয়েছিল। আরামবাগের সবথেকে নাম করা যে সরকারি স্কুলটি, সেখানকার শিক্ষকদের কতজন সন্তান সরকারি স্কুলে পড়ে তার খোঁজ নিতে গিয়ে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওই সরকারি বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকার ছেলে সিবিএসই বোর্ডের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে এখন। তিনি ওই বেসরকারি বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনে দারুণ খুশি। তাঁর মনে হয়েছে, সরকারি স্কুলে সন্তানকে পড়ালে বড় চাকরির পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়তে হবে ছেলেকে। আরেক শিক্ষিকারও একই বক্তব্য। তিনি বাংলা পড়ান। দিদিমণি বলেন, “আমার ছেলের সিবিএসই বোর্ড। ক্লাস নাইনে পড়ে। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

আরামবাগ শহরেরই এক সরকারি স্কুলের শিক্ষক তো বলেই দিলেন, মেয়ের ভিতটা যাতে ভাল হয়, তাই ছোট থেকেই বেসরকারি স্কুলে পড়াচ্ছেন। তাঁর কথায়, আজকাল সরকারি স্কুলে ছেলে মেয়েদের শাসন পর্যন্ত করা যায় না। কিছু বললেই হাজারো ঝক্কি। সেই স্কুলেরও বেশির ভাগ শিক্ষকই তাঁদের সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেছেন।

আরামবাগ শহর থেকে গোঘাটের দিকে যেতে সেখানেও দেখা গেল একই ছবি। নামকরা স্কুলের ইংরেজির এক শিক্ষক বলেন, “কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মিশন বহুমুখী বিদ্যালয়ে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাদের নিয়মশৃঙ্খলা কতটা। বাংলামাধ্যম স্কুল। অথচ শৃঙ্খলায় শীর্ষে। আমাদের সরকারি বিদ্যালয়ে তো এসব উঠেই গিয়েছে।” ওই শিক্ষকের ভয়ঙ্কর অভিযোগ, “যে পরিচালন সমিতি বিদ্যালয়কে পরিচালিত করে তাঁদের কতজন পড়াশোনা জানেন বলুন তো? অথচ মাথায় করে রাখতে হবে। শিক্ষক প্রতিবাদ করলে হেনস্থা করা হবে। আমরা সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা জানি কতটা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে কাজ করি। বাবা-মা হিসাবে আমরা তো চাইবই, আমার ছেলে ভালভাবে পড়াশোনা করুক।”

সরকারি স্কুলের প্রতি ঝোঁক কমার কারণ হিসাবে শিক্ষকরা যা বলছেন —

১. নামী সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষিকা যথেষ্ট আছেন, পরিকাঠামো আছে বিদ্যালয়ের। আছে পরিচালন সমিতিও। তবে গ্রামের দিকে শিক্ষক শিক্ষিকার অভাব রয়েছে।

২. আগে সরকারি বিদ্যালয় পরিচালন সমিতিতে অভিভাবক-প্রতিনিধিরা শিক্ষা সচেতন ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে স্কুলগুলিতে রাজনীতির হস্তক্ষেপ বাড়ছে। পরিচালন সমিতিতে স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকা লোকজন। শিক্ষানুরাগী অভিভাবকের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। পরিচালন সমিতির নজর শুধু মিড ডে মিলের গুণগতমান দেখার জন্য। শিক্ষার দিকে নজর নেই।

৩. সরকারি বিদ্যালয়ে যথেষ্ট যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের মন নেই ক্লাসে।

৪. সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করতে পারেন না। সরকারি বিদ্যালয়ে শাসন যেন উঠেই গিয়েছে। শাসন করলে থানায় অভিযোগ, রাস্তায় হুমকি, ঘেরাও কী হয় না আজকাল।

৫. বিদ্যালয়ের ভিতরে বাড়ছে মোবাইলের ব্যবহার, বাড়ছে মনোসংযোগের অভাবও।

৬. স্কুল শিক্ষা দফতরের নির্দেশ অনুযায়ী, পরীক্ষার সময় ছাত্ররা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেই নম্বর দিতে বাধ্য শিক্ষকরা। ফলে মূল্যায়ন পদ্ধতি শিকেয়।

এইসব কারণে শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের নিজের সন্তানকে আর সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াতে চাইছেন না। মাসে হাজার হাজার টাকা খরচ করে হলেও ভরসা রাখছেন বেসরকারি স্কুলগুলিতে। যাঁরা সরকারি স্কুলে পড়াচ্ছেন, তাঁরাই বলছেন, পড়াশোনার মান বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সিবিএসই, আইসিএসই বোর্ডেই ভরসা তাঁদের।