সুমন মহাপাত্র: “আনিস করবে জয়, শাসক পাবে ভয়।”-গান লিখেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। আলিয়া বলছে, “আমার ভাইয়ের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ।” বাংলা থেকে দিল্লি আনিস খানের ‘ইনসাফ’ চেয়ে তীব্র হচ্ছে আন্দোলন। এখনও সিবিআই তদন্তের দাবিতে অনড় প্রতিবাদী ছাত্রের পরিবার। বাবা, দাদা মিছিলে হাঁটছেন। রোজই বিভিন্ন সংগঠন, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা আনিসের বাড়িতে যাচ্ছেন। গিয়ে বলছেন, “পাশে আছি।” কিন্তু দিনের আলো নিভলেই অন্য ছবি আনিস খানের বাড়িতে।
ধূলাগড় টোল ট্যাক্স পার করে ডান দিক গেলে আমতা। সেখান থেকে বেতাই পেরিয়ে সারদা দক্ষিণ খাঁ পাড়া। তিনটে পুকুর পেরিয়ে, তারপর তিনতলা নির্মীয়মাণ একটা বাড়ি। কেউ চিনত না, কারোর চেনারও কথা নয়। কিন্তু গত সাত দিনে টিভির পর্দায় বা খবরের কাগজের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছে সেই বাড়ি। সন্ধ্যে নামলেই গোটা এলাকায় নিঝুম অন্ধকার। শেয়ালের ডাক ছাড়া আর কোনও আওয়াজ আসে না। মোড়ের মাথায় একটা ক্লাব আছে, সেখানেও আটটার পরে আর ভিড় থাকে না। পাড়ার চায়ের দোকান সাতটাতেই বন্ধ। আনিসকাণ্ডের পর এখন ভিড় বেড়েছে। মিডিয়া বুম, আলো নিয়ে বসে থাকে দশটা-এগারোটা পর্যন্ত। তারপর সব ফাঁকা। আনিসের মৃত্যুর পর অবশ্য একটা বড় বাতিস্তম্ভ বসেছে পাড়ার মোড়ে। তাই সেখানে আলো আছে। কিন্তু অন্ধকারেই ডুবে আনিস খানের বাড়ি।
সাধারণ সময়ে আনিসের বাড়িতে মেরেকেটে চার-পাঁচজন থাকতেন। কিন্তু এখন নীচের দুটো ঘরে চারজন, ওপরে একটি ঘরে আনিসের বাবা সালেম খান ও অন্য ঘরে আনিসের দাদা সাবির খান ঘুমোন। আর একটি ঘরে থাকেন আনিসে ভাগ্নি মুস্কান। মাঝখানে টিভির ঘরটায় ভিড়। আনিসের খুড়তুতো ভাই থেকে শুরু করে দূরসম্পর্কের আত্মীয়রা, সবাই ভিড় জমিয়েছেন ওই ঘরটায়। রাত বাড়লে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চলে এই চ্যানেল ওই চ্যানেল। প্রত্যেকের নজর টিভিতে। এই বুঝি একটা নতুন কিছু হল। আবার টিভি দেখেই তাঁরা জানছেন, বাড়িতে আসছেন বড় পুলিশ অফিসাররা। তৎক্ষণাৎ বাড়ছে ব্যস্ততা। রান্না হয় রোজ। কিন্তু কতজনের পাত পড়ে, তার হিসেব থাকে না। এই লোক, ওই লোক, কেউ চেনা কেউ অচেনা, সবাই আসছেন। সৌজন্য দেখিয়ে আনিসের প্রতিবেশীরা বলছেন, “খেয়ে যান।”
রবিবারের রাত। দিনেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, এসআইটি তদন্ত শুরু করেছে আনিসকাণ্ডের। পরক্ষণেই খবর এল বাঘা বাঘা অফিসাররা তদন্ত করতে আনিসের বাড়ি আসছেন। তৈরি হল আনিস খানের পরিবার। আটটা, নটা, পেরিয়ে দশটা। কোথায় এসআইটি? সাবির খান বারবার জিজ্ঞাসা করছেন সংবাদমাধ্যমকে। কারোর কাছেই কোনও উত্তর নেই। অতএব জাগতে হবে। সালেম খান অসুস্থ। তিনি আর পারছেন না। ওপরের ঘরে গিয়ে একটু গা এলিয়ে দিয়েছেন। তবে দরজার ফাঁক দিয়ে নজর টিভিতেই। টিভির সামনে বসে সাবির খান। এগারোটা নাগাদ দেখা গেল, আমতা থানায় তৎপরতা বাড়ছে। এবার আনিসের বাড়ি আসতে পারে এসআইটি। শুরু হল প্রহর গোনা। সালেম খান ততক্ষণে উঠে এসে টিভির সামনে খাটে বসেছেন। ঘড়ির তিনটে কাঁটা এক জায়গায় এল, বারোটা বাজল। দেখা নেই এসআইটির। বাড়ির নীচে তৈরি হল লিকার চা। বাটিতে করে খেলেন সালেমবাবু। কেটলি থেকে প্লাস্টিকের কাপে গড়িয়ে চা পৌঁছল অন্য সদস্যদের হাতে। সাবির খান এসে সাংবাদিকদের বললেন, “অনেক করছেন। একটু চা খেয়ে নিন।” এরপর চা গেল নীচে পাহারায় থাকা পুলিশ আধিকারিকদের কাছে। তাঁরাও চা খেলেন। ওপরে চেয়ার পাতা, সেখানে একমনে বসলেন সাবির। রাত কাটছে না, এসআইটি আসছে না, পরিবারেরও চোখে ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ বাদে টিভিতেও খবর দেখানো বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হল শুধুই বিজ্ঞাপন। সাংবাদিকদের কাছে আনিসের পরিবারের কাতর আর্তি, দয়া করে আপনারা চলে যাবেন না। পাশের ঘরে একটু ঘুমিয়ে নিন। সেই রাতে ঘুম আসেনি।
আনিসের বাড়ির সিঁড়িটা প্রচণ্ড খাড়া। তাড়াতাড়ি উঠতে গেলে যে কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সেই সিঁড়ি দিয়ে একাধিকবার গরম লিকার চা, চানাচুর মুড়ি এসেছে। কিন্তু এসআইটি আসেনি। ভোর হল, আনিসের বাড়ির যে কয়েকজন ঘুমিয়েছিলেন, তাঁরাও উঠে পড়লেন। আবার সাংবাদিকদের ভিড় বাড়ল। এসআইটিও এল। কিন্তু রাতের পর রাত ঘুম আর আসছে না আনিসের পরিবারের। ইনসাফ চাই। তাই রোজ রাতে পরের দিনের পরিকল্পনা হচ্ছে আনিসের বাড়িতে। কাল ‘হুজুর’ আসবে, পরশু তিনি, তারপরের দিন উনি। এই হিসেব কষতে কষতেই রাত কেটে যাচ্ছে সারদা দক্ষিণ খাঁ পাড়ার ছোট্ট ঘরে। ওনাদের আসার অপেক্ষা যখন চলছে,জানলা দিয়ে তখন ফুরফুর করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে। সেই জানালা, যে জানলা থেকে পড়ে গিয়েছিল আনিস খান।