
বানারহাট: ডুয়ার্সের আকাশে এখন শুধুই কালো মেঘ। প্রতিদিনের মতো সূর্য ওঠে ঠিকই, কিন্তু আলো নেই আমবাড়ি চা বাগানের হাজারো শ্রমিক পরিবারের জীবনে। শুধু প্রকৃতির নয়, সেখানকার মানুষের মনেও জমেছে অনিশ্চয়তার ঘন মেঘ। বানারহাটের আমবাড়ি চা বাগানে আজ আর কাঁচা পাতার ঝাঁঝ নেই, নেই শ্রমিকদের প্রাণখোলা হাসি। কারণ গত কুড়ি দিন ধরে বন্ধ পড়ে রয়েছে বাগান। বিনা নোটিসে হঠাৎ করেই মালিকপক্ষ গা-ঢাকা দিয়েছে। ফেলে রেখে গেছে হাজারো শ্রমিক পরিবারকে জীবনসংগ্রামের করুণতম পর্বে।
সকালবেলা প্রতিদিনের মতো কাজে এসে শ্রমিকেরা দেখে কারখানার দরজায় তালা। অফিস ঘর শুনশান। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে খবর। বাগান মালিক পালিয়ে গেছে। তারপর থেকেই শুরু বাঁচার লড়াই। কেউ ছুটছেন শ্রম দফতরে, কেউ ব্লকে, কেউ বা জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের দোরগোড়ায়। শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও একাধিকবার দরবার করেছেন, কিন্তু কোনও আশ্বাসই মেলেনি। না এসেছে সরকারি সাহায্য, না মিলেছে ত্রাণের আশ্বাস। দিন যত গড়িয়েছে, পেটের ক্ষুধা ততই বেড়েছে।
এই সঙ্কটের সময়ে চা শ্রমিক পরিবারের অনেকে বাধ্য হয়ে ভিন রাজ্যে রওনা হয়েছেন। কেউ কেরলে, কেউ দিল্লিতে, কেউ আবার বেঙ্গালুরুতে পৌঁছে গিয়েছেন। কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে মেয়েরাও। যাঁরা এতদিন বাগানের পাতা তোলায় মাথা গুঁজে থাকতেন, এখন তাঁরা শহরের হোটেলে বাসন মাজছেন কিংবা নির্মাণস্থলে ইট টানছেন। যাঁদের সামর্থ্য নেই বাইরে পাড়ি দেওয়ার, তাঁরা আশপাশের চা বাগানে সামান্য মজুরিতে দিন গুজরান করছেন।
আর এখানেই শুরু অন্য এক অন্ধকার অধ্যায়। রোজগারের প্রলোভন দেখিয়ে পাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে আবার। কয়েকদিন আগে শিলিগুড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে ৫৬ জন। রবিবার উদ্ধার হয় ৩৪ জন কিশোরী। তাঁদের গন্তব্য ছিল ভিন রাজ্যের নানা জায়গা। প্রশাসনের খবর বলছে, এই মেয়েদের অধিকাংশই ডুয়ার্সের বিভিন্ন চা বাগানের। নাগরাকাটা, মালবাজার, মেটেলি, এমনকি আলিপুরদুয়ারের নামও উঠে এসেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দু’দুবার এমন ঘটনা সামনে আসায় দুশ্চিন্তা আরও ঘনীভূত।
চা বাগান মানেই শুধুই কাজের জায়গা নয়, তা এই অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের রুটি-রুজি, আত্মপরিচয়। আজ সেই পরিচয়ের ভিত্তিই নড়ে গিয়েছে। আমবাড়ি চা বাগানে প্রায় ২০০০ শ্রমিক, স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে। পরিবার পিছু তিনজন ধরলে প্রায় ছ’হাজার মানুষ এই মুহূর্তে চরম সংকটে। খাবারের অভাব, চিকিৎসার অভাব, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অভাব—সব মিলিয়ে জীবনের প্রতিটি দিক আজ বিপর্যস্ত।
সরকারি সাহায্যের কথা বলতে গেলে শ্রমিকদের অভিযোগ, রেশনের সামান্য চাল ছাড়া কিছুই মেলেনি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, চালেই কি চলে সংসার? রান্নার তেল, সবজি, নুন, শিশুদের দুধ, অসুস্থ বৃদ্ধদের ওষুধ—এসবের জন্য প্রয়োজন টাকা। সেই টাকাই নেই তাঁদের হাতে। পুজোর আগে মুহূর্তে এই বঞ্চনার বোঝা যেন আরও পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠেছে।
এই সঙ্কটের দিনে প্রশাসনের এমন নিষ্ক্রিয়তা অনেককেই হতাশ করেছে। যাঁরা ভোটের আগে বাগানে এসে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়ান, তাঁরাই আজ নিরুদ্দেশ। শ্রমিকেরা বলছেন, “আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই দেখতে কেউ আসে না। না আসে এলাকার মন্ত্রী, না আসে সরকারি আধিকারিক। আমরা কি এই রাজ্যের নাগরিক নই?”
চা বাগান ডুয়ার্সের প্রাণ। সেই প্রাণ যখন ধুঁকছে, তখন তার সুরক্ষায় প্রশাসন, সরকার—সবাই যেন চুপ। অথচ ঠিক এখনই প্রয়োজন জরুরি ত্রাণ, রোজগারের সুযোগ, এবং সবথেকে বেশি। পাচার রোধে কঠোর নজরদারি। নইলে এই অন্ধকার আরও গভীর হবে, হারিয়ে যাবে আরও অনেক স্বপ্ন, আরও অনেক মুখ।