পশ্চিমবঙ্গ: ২০০ বছরের বিট্রিশ সাম্রাজ্য়বাদ থেকে মুক্ত হল রাষ্ট্র। স্বাধীন ভারতবর্ষ। শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য়বাদ থেকেই মুক্ত হল এমন নয়, গায়ে নিয়ে এল কাঁটাতারের যন্ত্রণা। তৎকালীন পরাধীন ভারতের ভাইসরয় লুইস মাউন্টব্যাটেনের কলমের এক আঁচড়ে তৈরি হল স্বাধীন ভারতবর্ষ, পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান তথা অধুনা পাকিস্তান। সেই বাঁটোয়ারায় ইংরেজ সাহেব দেখলেন না ঠিক কোথা থেকে কী বদল হয়ে গেল। কাদের জীবনে এল স্বাধীনতা, কারা জানতেই পারলেন না তাঁরা আদৌও স্বাধীন কি না! ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট যখন দেশ স্বাধীন হচ্ছে তখনও স্বাধীনতা আসেনি কিছু স্থানে। কোথাও উড়েছে পাকিস্তানের পতাকা। কারণ, সীমান্তের কালো মোটা দাগ ততক্ষণে ভারত রাষ্ট্রের গায়ে চেপে বসেছে। তিন দিন পর এসেছিল স্বাধীনতার সেই সফেন সকাল। ১৮ অগস্টের নতুন ভোরে নো ম্যানস ল্যান্ড বরণ করেছিল স্বাধীনতাকে। পরে যে স্বাধীনতা লেখা হয়েছিল রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে।
মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনা; চারটি স্বাধীন জেলার নিকটেই সীমান্ত। সেই সীমান্ত বলতে কেবল কাঁটাতার। সে কাঁটাতারও বসানেো হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের ‘টি-পার্টির’ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় হিন্দুদের এ পারে রাখা, কাঁটাতারের ওপারে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে যাক মুসলিমরা। কিন্তু মাউন্টব্যাটেনের হিসেব নিকেশ পছন্দ হয়নি বাকি সরকারি আধিকারিকদের। অগত্যা ফের বদল। রাতারাতি মানচিত্রে কলম চালিয়ে সীমান্ত টেনে দেওয়া হল ওই চারটি জেলা ঘেঁষে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেও ভিনদেশ।
‘মোর দ্যাশ ওপারের খুলনায়’, সুপুরিবনের সারি পেরিয়ে নীলু যখন এপারে চলে আসছিল তখন নিজের সেই গ্রামের বাড়ি, বন, হাঁসেদের চইচইকে বুকে আগলে রেখে দাঁড়িয়েছিলেন এক বৃদ্ধ। একা। শঙ্খ ঘোষের সেই বর্ণনায় আস্ত একটা সীমান্ত জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল সুপুরিবনের মধ্যে। রাষ্ট্র নামক গঠনতন্ত্রের বদলে দেশ নামের ‘ঘরবাড়ির’ সন্ধান অনেক পরে পেয়েছে দেশবাসী। বঙ্গসীমান্তে তখন রাজনীতির ক্লেদাক্ত বাতাস। ইতিহাসবিদ বিষাণ গুপ্ত জানিয়েছেন, ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তে কটিদেশে খুলনা আর মুর্শিদাবাদ। জনসংখ্যার বিচারে বরাবরই খুলনায় হিন্দুদের ও মুর্শিদাবাদে মুসলিম জনঘনত্ব বেশি। ফলে মুর্শিদাবাদকে পাঠাতে হবে ওপারে। খুলনা থাকবে এপারে। মুসলিম লিগের এই দাবিতে ১৫ অগস্ট, ভারতের ঘোষিত স্বাধীনতা দিবসেই মুর্শিদাবাদে জেলাশাসক দফতর-সহ একাধিক জায়গায় তোলা হল পাকিস্তানের পতাকা। তারপরেও বিনিময় প্রথায় বদল হয়নি। সীমান্তভাগের সিদ্ধান্ত মেনেই খুলনা গেল ওপারে পূর্ব পাকিস্তানে, মুর্শিদাবাদ থাকল এপারে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হল ১৮ অগস্ট। ভারতের জাতীয় পতাকা উড়ল মুর্শিদাবাদে। সেই থেকে আজও ১৮ অগস্ট মুর্শিদাবাদে পালিত হয় স্বাধীনতা দিবস। এখন সেখানে ওড়ে ভারতের তেরঙ্গা।
মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার মানুষ তখনও বোঝেননি তাঁরা এপারের না ওপারের। ইতিহাস বলছে, গোটা এই এপার-ওপারের বিচার করতে ১৫ অগস্ট পেরিয়ে গিয়েছিল। তখনকার রেডিওতে অবশেষে ১৮ অগস্ট শোনা গিয়েছিল স্বাধীন ভারতের বার্তা। সেই থেকেই ওই চার জেলায় পালিত হয় স্বাধীনতা দিবস। সেই নিয়ম মেনে এবছরেও নদিয়ার শান্তিপুর, রানাঘাট মাজদিয়া-সহ একাধিক এলাকায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। নদিয়া জেলার শান্তিপুর,মাজদিয়া এলাকাগুলি পরে ভারতভুক্ত হয়।
‘৪৭-এর ১৮ অগস্ট মালদার ছবি ছিল অন্যরকম। তখন এলাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের রুটমার্চ। ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’ তখন পরস্পরের সন্দেহভাজন। চোখে নেই বিশ্বাসের রঙ। সম্প্রীতির মমত্ব। সেই সময়, মালদা জেলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্তকরণের আবেদন জানানো হয়। ভারতভুক্ত হওয়ার পরেও যদিও উদ্বাস্তু যন্ত্রণার উপশম হয়নি। শুকিয়ে যায়নি সেই আঁধারের ক্ষত। পঁচাত্তর বছর পর একুশের ১৮ অগস্ট বুধবার সকাল থেকেই মালদা শহরের রামকৃষ্ণ মিশন ঘাট এলাকায় উদযাপন করা হয় স্বাধীনতা দিবস। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায়। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন, প্রাক্তন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী, ইংরেজ বাজার পৌরসভার প্রশাসক সুমালা আগারওয়ালা সহ অন্যান্য অতিথিরা। পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী শিবেন্দু শেখর রায়ের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। একইভাবে সীমান্তবর্তী বনগাঁতেও ১৮ অগস্টই পালিত হয় স্বাধীনতা দিবস।
বস্তুত, ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ একটা নিখুঁত ফারাক। কার মধ্যে? কীসের মধ্যে? মাপামাপি করতে যাওয়া নিতান্ত বোকামি। কখনও দেশ, কখনও কাল, কখনও একেবারে অন্তরাত্মায় সিঁটিয়ে থাকে যে ব্যবধান। বেড়া বা কাঁটাতার, অদৃশ্য গণ্ডির দৃশ্যমান চলাফেরায় আবদ্ধ থাকে জীবন। ঘেরার এ দিক থেকে যত দূরত্ব অতিক্রান্ত, ও দিকেও হয়তো সমান দূরত্ব অতিক্রম্য। সেই সীমান্ত বরাবর যে ব্যবধান তা আজও উপড়ে ফেলা যায়নি। দগদগে ক্ষতের মতো এক অন্য স্বাধীনতা, ভুলচুক করে পাওয়া স্বাধীনতা কেবল একটা রেখায় আলাদা সমীকরণ তৈরি করে। ‘রচে নানা ব্যবধান, নানা ইতিহাস’। আরও পড়ুন: ‘ঝেঁকে ধরেছিল তালিবান, ভারতের পাসপোর্ট দেখাতেই…’ গলা ধরে আসে চুঁচুড়ার কাবুলিওয়ালার