সন্দেশখালি: সন্দেশখালি! নামটা শুনলেই মনে হয় সন্ত্রাসের কথা! জমি দখল, নারী নির্যাতন, সেখান থেকে উঠে আসা একাধিক অভিযোগের কথা। আর যাঁর নেপথ্যে উঠে আসা ‘ত্রাস’ শাহজাহানের নাম। কিন্তু সেই সন্দেশখালিই আজ আবার শিরোনামে। না ভাইরাল ভিডিয়ো, নির্যাতনের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, মিথ্যা অভিযোগ- এসবের ঊর্ধ্বে উঠে এক অন্য মাত্রায়, অন্য আঙ্গিকে। উচ্চশিক্ষায় মেধার তালিকাতেও নাম করে নিল সন্দেশখালি। নেপথ্যে সেই ছেলে, যার বাবাকে ‘খুন’ হতে হয়েছিল শাহজাহানের হাতে। মনে আছে সন্দেশখালির হাটগাছি অঞ্চলের সেই প্রদীপ মণ্ডলের কথা? যাঁকে খুনে নাম জড়িয়েছে শাহজাহানের। অভিযোগ ওঠে, বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চোখের মনিতে গুলি করে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল প্রদীপকে। তখন তাঁর দুই ছেলেই ছোট। বড় ছেলে প্রীতমের তখন ভালোই জ্ঞান। চোখের বাবাকে ছটফট করে শেষ হতে দেখেছিল। মায়ের হাত ধরে সেদিনের পর দুইভাই গ্রাম ছেড়েছিল। পুলিশের FIR এ প্রথমে শাহজাহানের নাম থাকা সত্ত্বেও পরে নাম সরিয়ে দেওয়া। হাইকোর্টে সেই মামলা এখনও বিচারাধীন। প্রদীপের সেই ছেলে প্রীতমই নাম উজ্জ্বল করল সন্দেশখালির। উচ্চ মাধ্য়মিকে ৯৬ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে সে। উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৮৩ পেয়ে বুঝিয়ে দিল সন্ত্রাস মেধা আটকাতে পারে না। এখনও আইপিএস হতে দিল্লির উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে প্রীতম। কি মনে হচ্ছে না, সন্দেশখালির এই গোটা আগামী দিনের কোনও এক সিনেমার চিত্রপট! বাস্তবেই গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো এক সত্যতা।
২০১৯ সালের জামাইষষ্ঠীর দিন। অভিযোগ ওঠে, সেদিন শাহজাহানের লেঠেল বাহিনী হাজার লোক হামলা চালিয়েছিল হাটগাছি অঞ্চলের ৫৬ নম্বর বুথের বিজেপি কর্মী প্রদীপ মণ্ডলের বাড়িতে। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে গুলি করে খুন করা হয়েছিল তাঁকে। বাবাকে নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছিল প্রীতম। সঙ্গে নিজের ও মা-ভাইয়ের প্রাণসংশয়ের ভয় ছিল। ওই অবস্থাতেই প্রদীপের স্ত্রী পদ্মা শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন। ফিশারি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু একুশের নির্বাচনের পর সেই ফিশারিও শাহজাহান বাহিনী দখল করে নেয় বলে অভিযোগ। তারপর থেকে ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাতেন। আর স্বপ্ন দেখে চলেতেন, সন্দেশখালির বুকে দাঁড়িয়েই দুই ছেলেকে মানুষ করার। প্রীতমের তখন কতই বা বয়েস! পড়াশোনার জন্য নয়, ছেলে যাতে বেঁচে থাকে, তার জন্য ছোটবেলাতেই আবাসিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন পদ্মা। তখন ‘UPSC’, ‘IPS’ এর অর্থ বুঝত না প্রীতম। তবে সমাজের ‘কীটগুলোকে’ মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর ছিল। মাধ্যমিকের পর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হয়। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে এবারের উচ্চ মাধ্যমিকে ৯৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছে প্রীতম।
প্রীতম বড় হয়ে আইপিএস অফিসার হতে চায়। তার কথায়, “বাবার ‘খুনের’ সময় ‘ঠুঁটো জগন্নাথের’ মতো বসেছিল পুলিশ। সমাজের কীটদের নির্মূল করতে চাই।” ছেলে আজ সফল! দুই ছেলেকে আঁকড়েই যে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন পদ্মা। আজ তিনিও সফল। তাঁর লড়াই সফল! সমাজের ‘কীটদের’ মুখে জবাব দিতে পেরেছেন তিনি। স্বামীর ‘খুনি’দের মামলা চলছে আদালতে। তবে আজও পদ্মা গ্রামে ফিরতে পারেন না। যাতায়াত করেন। কারণ সেখানে শ্বশুরের ভিটের আশপাশে বেশ কিছু জমি-জায়গা, ভেড়ি রয়েছে, সেগুলো দেখাশোনা করতে হয়। কিন্তু পাকাাপাকি ফিরবেন না। কারণ এখনও বেশ কয়েকজন অভিযুক্ত অধরা। পদ্মা বললেন, “আজ আমার সিঁথি সিঁদুর হারা। আমার সন্তান আমার মুখে এতদিন পর হাসি ফিরিয়েছে। অনেক কষ্ট করেছি, অনেকটা লড়াই। আজ খানিকটা স্বস্তি মিলছে। কিন্তু আজও আমি আমার মানুষটাকে পাশে পাই না। ওর বাবা থাকলে আরও অনেক বেশি আনন্দ পেত। আজও আমার মুখের হাসির থেকে চোখের জলটাই চলে আসছে… “