পশ্চিম বর্ধমান: রাজ্যে করোনা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। তবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা না করে এখনই সব কিছু বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষপাতী নন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখনও বর্ষবরণের উৎসবে রাশ টানেনি রাজ্য সরকার। সংক্রমণের ক্রমবৃদ্ধিতে রাজ্যসরকারকে নির্দ্বিধায় কাঠগড়ায় তুলছে বিরোধী শিবিরগুলি। এ বার সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করলেন বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অগ্নিমিত্রা পাল (Agnimitra Paul)।
বিজেপি নেত্রীর যুক্তি
বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে অগ্নিমিত্রা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বর্ষবরণে ব্যস্ত! ৩১ ডিসেম্বরও তিনি নাইট কার্ফু জারি করতে পারলেন না! এদিকে সর্বত্র জনজোয়ার। সকলেই জানেন কী হারে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে!” এর আগে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও একই অভিযোগ করেছিলেন। শুভেন্দু বলেছিলেন, “পার্কস্ট্রিটের জনজোয়ার আর মেয়রের শপথগ্রহণ থার্ড ওয়েভের আঁতুড়ঘর।” তাঁর আরও সংযোজন, “মেয়রের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে দেখুন, সেখানেও এক আধজন করোনা আক্রান্ত। অনেকেরই জ্বর এসেছে। টেস্ট করালে অনেক কাউন্সিলরেরও করোনা ধরা পড়বে। ওখান থেকেই থার্ড ওয়েভ আসছে।”
সম্প্রতি, কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ফিরহাদ হাকিম। মেয়রের শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ৪ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সাধনা বসু। তাঁর কোভিড পজিটিভ ধরা পড়েছে। শুধু সাধনাই নন, আক্রান্তের তালিকায় রয়েছেন খোদ মেয়র ফিরহাদ হাকিমের ঘরে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটরও। বুধবার তাঁর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। সূত্রের খবর, ফিরহাদ হাকিমের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন এমন প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ
অন্যদিকে, বড়দিন থেকে যেভাবে পার্কস্ট্রিট চত্বরে জনজোয়ারের ছবি সামনে এসেছে তাতে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞ মহল। শুধু, পার্কস্ট্রিট নয়, আসন্ন গঙ্গাসাগর মেলাতেও বিপুল জনসমাগম হতে পারে। ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রভূত সম্ভাবনা। সেখানে কী করে গঙ্গাসাগর মেলার ছাড়পত্র দিয়েছে রাজ্য সরকার তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে বিরোধী শিবির। যদিও, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোদ জানিয়েছেন, পরিস্থিতি পর্যালোচনা না করে এখনই সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হবে না।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘করোনার জন্য অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবার নতুন করে সব কিছু বন্ধের পথে গেলে সাধারণ মানুষের উপর চাপ তৈরি হবে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তবেই এ ব্যাপারে সিন্ধান্ত নেওয়া হবে।’’ কেন পর্যালোচনা প্রয়োজন তা ব্যাখা করে তিনি বলেন, ‘‘কোভিড তো প্রায় ছ’মাস-আট মাস ছিল না। তাই অনেক জায়গায় কোভিড হাসপালগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সার্বিক ভাবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’’
বঙ্গের হালহকিকত
বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের উৎসবে বহুমানুষ রাস্তায় নামবেন। ফলে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বর্ষবরণের উৎসব আটকাব কী করে! তবে আমরা বর্ষবরণের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি।’’ এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকেও সচেতন থাকার পরামর্শ দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘সকলকে কোভিড বিধি মেনে চলার অনুরোধ করছি।’’
কিন্তু, সত্যিই কি মানা হচ্ছে কোভিড বিধি। শুক্রবারের সকাল থেকে যে ছবি দেখা গিয়েছে তাতে কিন্তু ভয়টাই বাড়ছে। মাস্ক ছাড়াই দিব্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে। প্রশ্ন করলে পাল্টা বলছেন, “এ উৎসব তো দিনদুয়েকের। তাতে আর কী এমন বিপদ হবে! কী ই বা সংক্রমণ ছড়াবে!” অরক্ষিত মুখগুলির মতো এমন ‘গা-ছাড়া’ মনোভাবই শিউরে ওঠার কারণ! কবে সচেতন হবেন মানুষ! একবছর উৎসব পালন না করলে কি খুব বড় বিপদ হবে? অন্তত, এমনটাই প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা ।
বৃহস্পতিবারের বুলেটিন অনুযায়ী, এ রাজ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ২ হাজার ১২৮ জন। এর মধ্যে কলকাতায় সংক্রমিত ১ হাজার ৯০ জন। মৃতের সংখ্যাও বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ জন করোনার বলি হয়েছেন। এর মধ্যে কলকাতায় মৃত্যু হয়েছে চারজনের।
নমুনা পরীক্ষা বাড়েনি, তাতেই এই!
এতেই অবাক হলে চলবে না। উদ্বেগ এখনও বাকি! গত ২৪ ঘণ্টায় দৈনিক সংক্রমণের পরিসংখ্যানকে কার্যত সুনামি বলছে ওয়াকিবহাল মহল। অথচ বুধবার ও বৃহস্পতিবারের নমুনা পরীক্ষায় কিন্তু খুব একটা ফারাক হয়নি। স্বাস্থ্য ভবনের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৩৭৫টি। বৃহস্পতিবার তা সামান্য বেড়ে ৩৮ হাজার ৮৯৮ হয়েছে। অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে ৫২৩টি। কিন্তু হাজারের উপরে বেড়ে গিয়েছে সংক্রমণ।
শুক্রবার থেকেই মাইক্রো কনটেনমেন্ট জ়োন
প্রথমে ৩ জানুয়ারি থেকে মাইক্রো কনটেনমেন্ট জ়োনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছিল। এখন যা পরিস্থিতি তাতে এটুকু অপেক্ষার মাশুলও হয়ত অনেক দামী হতে পারে। সে কারণে যে সব এলাকায় করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ধরা পড়ছে, সেই সমস্ত জায়গায় মাইক্রো কন্টেনমেন্ট জ়োন তৈরির নির্দেশ জারি হয়ে গিয়েছেন। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, শুক্রবার থেকেই কলকাতা পুর এলাকার বেশি কিছু জায়গায় মাইক্রো কন্টেনমেন্ট জ়োন চালু হয়ে যাবে।
জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তা। জোর দেওয়া হচ্ছে কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়েও। ওমিক্রন সন্দেহভাজনেরা ফোন না ধরলে প্রয়োজনে বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। সন্দেহভাজন হোম আইসোলেশন মানছেন কি না তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে জিও ট্যাগিংয়ের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ স্বাস্থ্য ভবনের।
গোষ্ঠী সংক্রমণ কি শুরু?
কলকাতায় মিলেছে গোষ্ঠী সংক্রমণের ইঙ্গিত। ইতিমধ্যেই জেলায় জেলায় সতর্কবার্তা দিয়েছে স্বাস্থ্যভবন। প্রকাশ্যে আসছে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য। এক সপ্তাহের মধ্যেই একেবারে চূড়ায় পৌঁছতে পারে সংক্রমণ। দৈনিক সংক্রমণের ৩০-৩৫ হাজার ছুঁতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষার হারেও বিপদ বার্তা দিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, বেসরকারি ল্যাবে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে টেস্ট। হাতে আসা তথ্য নতুন করে ভয় ধরাচ্ছে মনে।
আরও পড়ুন: Asansol Municipal Election: ‘আমাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত’, বর্ষশেষে বিজেপির কাটছে জট?