পূর্ব মেদিনীপুর: শান্তিকুঞ্জে (Contai) এখন শিশির পতনের নীরবতা। ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে বাড়িতেই রয়েছেন অধিকারীরা। বাড়ির কর্তা শিশির অধিকারী থেকে শুভেন্দু, সৌমেন্দু সকলেই কার্যত নিজেদের ‘ঘরবন্দি’ করে রেখেছেন। শান্তিকুঞ্জ একেবারে শান্ত। ভিতরে যে কী চলছে মিলছে না আঁচ। বাইরে থেকে দেখে যতটুকু বলা যায়, তাতে গত ৪৮ ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহে একেবারে নিস্তরঙ্গ, নিস্তব্ধ কাঁথির অধিকারী বাড়ি।
একুশের ভোটে নন্দীগ্রামের দিকে নজর ছিল সকলের। কার্যত ২৯৪ আসনের মধ্যে নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রই ছিল এপিসেন্টার। ভোটের ফল ঘোষণার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা জিইয়ে ছিল এ কেন্দ্রে। চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পরও চরিত্র বদলে বহাল উত্তেজনা। ফল ঘোষণার পর একটা টুইট করেছিলেন শুভেন্দু। ব্যস! ওই অবধি। এরপর আর তাঁকে জনসমক্ষে পাওয়া যায়নি। শিশিরবাবুও কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে চাইছেন না।
সোমবারের পর মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কাউকে শান্তিকুঞ্জ থেকে বের হতে দেখা যায়নি। বাড়ির খোলা জানলা থেকেও নজরে আসেনি কারও উঁকি। কার থেকে মুখ ফেরাল শান্তিকুঞ্জ? বাইরে যেমন বাহিনীর জওয়ানরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, বেড়াচ্ছেন। বাড়ির ভিতরে কোনও তৎপর আনাগোনা নেই। জায়গাটার নাম করকুলি। কলেজ মোড় থেকে হেঁটে বা গাড়িতে ঢুকলে ডানদিকে শুভেন্দু অধিকারীর বাড়ি। বাড়ির সামনের চৌহদ্দি বা এই কলেজ মোড়ও কেউ মাড়াচ্ছেন না।
অথচ মাস খানেক আগে এ তল্লাটের ছবিটাই ছিল ভিন্ন। রাজ্য, ভিনরাজ্য বা জাতীয় স্তরের মিডিয়া, কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বের ভিড়, বাহিনীর ভারী বুটের আওয়াজে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। সে তল্লাট এখন খাঁ খাঁ। দু’ চারজন যাচ্ছেন বটে এ রাস্তা ধরেই, কিন্তু সে অন্য কোথাও। শান্তিকুঞ্জের দিকে চোখ গেলেই ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে কারোর কারোর।
এখান থেকে মাত্র ১৫০ মিটার দূরে কাঁথি মোড়ের ছবিটা একেবারে আলাদা। কাছেই রক্ততিলক ক্লাব। তার সামনেই বাজি ফাটিয়ে, এর তার মুখে সবুজ আবির মাখিয়ে জয় সেলিব্রেট করেছে তৃণমূল। ডিজে মিউজিকের ঝন ঝনানিতে কান পাতা দায়। ‘গড়’ শব্দের অর্থ তাদের কাছে একটাই। কোনওরকমে যেটুকু শোনা গেল, তাতে তাঁরা বলছেন, “এখানে গড় বলতে একজনেরই। সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।”
আরও পড়ুন: কোভিডের বাড়বাড়ন্ত, সিবিআই দফতরে যেতে ‘নারাজ’ লালার ‘লিঙ্কম্যান’ বিনয় মিশ্র
অন্যদিকে, স্থানীয় বিজেপি বা অধিকারী পরিবারের তরফ থেকে শেষ পাওয়া প্রতিক্রিয়া ২ মে গণনার শেষে। সার্টিফিকেট নিতে যাওয়ার পথে আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন শুভেন্দু। তা আর নেওয়া হয়নি। মোট চারটে গাড়ি ভেঙেছিল সেদিন। শুভেন্দুর গাড়ির পিছনে একটা আধলা ইট উড়ে আসতেও দেখা গিয়েছিল। বুলেট প্রুফ গাড়িটার সে অর্থে কোনও ক্ষতি সেদিন হয়নি। যদিও গণনাকেন্দ্রে ঢোকার আগে সেদিন নিজের গাড়ি বদলে নিয়েছিলেন তিনি। হতে পারে এমন কিছু হওয়ার আঁচ পেয়েছিলেন আগেই। তাতেও রেহাই মেলেনি। কেন্দ্রে ঢোকার মুখেই তৃণমূল কর্মীদের প্রবল আস্ফালন বিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল। কোন মতে বাড়ি ফেরেন। তার পর থেকেই নিস্তব্ধ শান্তিকুঞ্জ।
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, এর কারণ স্পষ্ট। আধ লাখ ভোটে মমতাকে হারানোর চ্যালেঞ্জ করেছিলেন শুভেন্দু। জয়ী হয়েছেন দেড় হাজারের কিছু বেশি ভোটে। তাও রিটার্নিং অফিসারকে খুনের হুমকি দিয়ে গণনায় কারচুপি করে জেতা বলে অভিযোগ তুলেছেন মমতা। নন্দীগ্রাম ছাড়া অবশ্য উত্তর ও দক্ষিণ কাঁথি এই দুটো আসনে নিজেদের দখল রাখতে পেরেছেন শুভেন্দু। সার্বিকভাবে রাজ্যস্তরে শুধু মান রক্ষা হয়েছে বিরোধী দলের তকমা পেয়ে। ব্যস ওটুকুই। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়ে ছেলে এখন ‘জায়ান্ট কিলার’ হলেও অধিকারী বাড়িতে উচ্ছ্বাসের বাতাবরণ নেই।
বরং, রাজ্যস্তরে ফল খারাপ নিয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন অধিকারীরা। ঘনিষ্ঠমহলে শিশিরবাবু সে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বলেও শোনা গিয়েছে। যদিও এর সত্যতা বিচারের সুযোগ মেলেনি। সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই ফলের পর্যালোচনায় শিশিরবাবুর বক্তব্য, “আমি আউট সাইডার। ভোটে তৃণমূল বিজেপির এই ফলাফল নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই।”