কলকাতা: আরও পাঁচ বছরের জন্য মেয়ের হাতেই থাকছে বাংলা। ভোটগণনা শুরু হওয়ার ১০ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর এই বিষয়ে আর কোনও সংশয় নেই। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হ্যাটট্রিকের পথে এগোচ্ছে তৃণমূল। অন্যদিকে, বিজেপি ২০০ আসন পাওয়ার দাবি করলেও গেরুয়া শিবির ৮৫ পেরোতে পারবেন কি না সেটা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে ১০ বছর শাসনে থাকার পরও কীভাবে এত বিরাট ব্যবধানে জয়? প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বলে কি কিছুই ছিল না বঙ্গে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেশ কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে, যা কার্যত মমতার তৃতীয়বারে ঐতিহাসিক জয় নিশ্চিত করেছে বঙ্গে।
তৃণমূল সুপ্রিমোর জয়ের এক এবং অদ্বিতীয় কারণ, প্রধান বিরোধী শক্তির মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থী সামনে না রাখা। বিজেপি নেতারা রাজ্যে মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চ্যালেঞ্জ নিলেও তাঁরা একটা কাজ করতে পারেননি। সেটা হল, মমতার বদলে বাংলার ১০ কোটি জনগণ কাকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেবেন, সেই সুযোগ দেননি। বঙ্গ বিজেপি শিবিরে একঝাঁক তারকা নেতা থাকলেও ক্ষমতায় এলে কে সরকারকে নেতৃত্ব দেবেন, সেই ছবিটাই স্পষ্ট করা হয়নি বাংলার ভোটারদের কাছে।
একুশের বিধানসভায় কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে বাম-কংগ্রেস ও আইএসএফ জোটকে। অর্থাৎ, বিজেপি বিরোধী সমস্ত ভোটই যে কার্যত তৃণমূলের ঝুলিতে এ বার গিয়েছে, তা নিয়ে আর কোনও সংশয় নেই। শেষ পাওয়া খবরে বিজেপি এবং তৃণমূলের ভোটের যে ফারাক দেখা যাচ্ছে, তা এককথায় অভাবনীয়। রাজ্যে প্রায় ৪৮.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি পেয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ ভোটে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। ফলে যে বামেদের বড় অংশের ভোট ২০১৯ সালে রামের দিকে গিয়েছিল, তা এ বার বিজেপিকে ঠেকাতে অনেকটাই ঘাসফুলের দিকে গিয়েছে। মালদা এবং মুর্শিদাবাদের মতো জেলা, যা কংগ্রেসের গড় হিসেবেই পরিচিত, সেখানেও প্রথমবার বিরাট ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। সমগ্র বিজেপি বিরোধী ভোটটাই তৃণমূলের ঝুলিতে চলে আসায় ঐতিহাসিক জয়লাভ করেছে ঘাসফুল।
মমতার জয়ের আরেক অন্যতম কারণ, কোনও না কোনও পরিষেবা দ্বারা বিরাট অংশের জনগণের জীবনে প্রভাবিত করা। সরকারি জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের কথা যদি বলতে হয়, তবে বিগত ১০ বছরে তৃণমূল সরকার একের পর এক প্রকল্প রাজ্যবাসীর সামনে নিয়ে এসেছে। কখনও ‘কন্যাশ্রী’, কখনও ‘রূপশ্রী’, সর্বশেষ প্রকল্প হিসেবে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ যে রাজ্যের মানুষের জীবনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটাই আজকের ফলাফল থেকে পরিষ্কার।
আরও পড়ুন: ‘জয়ী’ হয়েও নন্দীগ্রামে ‘পরাজিত’ মমতা, বললেন ‘মানুষ যা করে ভালর জন্যই করে’
২০১৯ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সামনে আসার পর থরহরিকম্প শুরু হয়েছিল কালীঘাটে। সেই ক্ষত মেরামত করতেই ভোটকুশলী হিসেবে প্রশান্ত কিশোরকে নিয়োগ করেন মমতা। তাঁর হাত ধরেই ছত্রভঙ্গ অবস্থা থেকে ক্রমশ সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে তৃণমূল। ‘দিদিকে বলো’ এবং ‘দুয়ারে সরকারের’ মতো একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের আরও কাছে পৌঁছনোর যে চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটাও যে সফল হয়েছে তা আজকের ফলাফল থেকেই স্পষ্ট।
একুশের বঙ্গযুদ্ধে ‘খেলতে’ নেমে বিজেপির বেশ কিছু পদক্ষেপ এ দিন কার্যত আত্মঘাতী গোল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। যা পক্ষান্তরে ভোটের সময় তৃণমূলের সুবিধা করে দিয়েছেন বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। প্রথমত, কোনও ছাঁকনি ছাড়াই ঝাঁকে ঝাঁকে তৃণমূলের নেতাদের দলে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, সদ্য দলবদলু নেতাদের টিকিট দেওয়া। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর ঘোষাল, বৈশালী ডালমিয়া, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর মতো বেশিরভাগ দলবদলু নেতারাই বিরাট ব্যবধানে হেরে গিয়েছেন। ফলে মানুষ যে এটা মোটেই ইতিবাচকভাবে নেয়নি, সেটা ফলাফলেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই সবগুলি কারণই কার্যত তৃতীয়বারের জন্য মসনদে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা।
আরও পড়ুন: ‘আমাদের ত্রুটি ছিল’, মমতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আত্মসমালোচনা বিজেপির