
সোনা সোনা সোনা। ডিজিটাল থেকে ফিজিকাল, টাকা বাদে চারদিকে এখন অ্যাসেট বলতে একটাই বিষয় ঘুরছে জনসাধারণের মাথায়। ভারতে যেখানে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সোনার দাম, সেখানে সোনার দাম কমাতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিল আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তবে রাষ্ট্রটির নাম যেহেতু চিন এবং সেই দেশের সর্বাধিনায়কের নাম যেহেতু শি-জিনপিং, সেই ক্ষেত্রে ভারতের কতটা সুরাহা হবে―সে বিষয়ে সন্দেহ থাকছেই। তবে চিনে কী এমন ঘটল যাতে সোনার দাম হুড়মুড়িয়ে কমার সম্ভাবনা?
সোনার দাম কমার প্রসঙ্গে পরে, তবে আগে আপনাকে জানতে হবে চিনের এক অদ্ভুত ঘটনা সম্পর্কে! ঘটনাস্থল চিনের একটা ছোট্ট এলাকা। শিনজিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের পশ্চিম সীমান্তের কাছে কুনলুন পর্বতমালায় নাকি একটি বিরল সোনার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে, এই তথ্য দিয়েছে খনি জরিপে যুক্ত সরকারি ভূতত্ত্ববিদরা। চৈনিক সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক হিসাব বলছে, এই খনিতে মোট মজুত সোনার পরিমাণ ১,০০০ টনেরও বেশি হতে পারে। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত কাশগর জিওলজিক্যাল টিমের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হে ফুবাও এবং তাঁর সহকর্মীরা এ প্রসঙ্গে বহু তথ্য দিয়েছেন। ৪ নভেম্বর পিয়ার-রিভিউ জার্নাল Acta Geoscientica Sinica-তে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে নানা তথ্য মিলেছে ইতিমধ্যেই।
ইতিপূর্বে উত্তর-পূর্ব লিয়াওনিং এবং হুনান প্রদেশে বড় দুটি সোনার খনি আবিষ্কৃত হয়েছিল। তার পর এক বছরও পেরোয়নি, চিনা কর্তৃপক্ষের হাতে তৃতীয় বড় সোনার খনি চলেই এল। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এই ধরনের বড়সড় সোনার খনিগুলোতে সাধারণত কয়েকশো টনের বেশি সোনা পাওয়া সম্ভব হত না। তবে চিনের সাম্প্রতিক ঘোষণায় চমকে উঠেছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল! যেহেতু চিনের বহু তথ্যই দেশের বাইরে সহজে আসে না, তাই এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই সকল তথ্য আহরণ এখনই সম্ভব হয়নি।
শিল্প বিশেষজ্ঞদের অনুমান—চিনে খনন করা হয়নি এমন সোনার পরিমাণ প্রায় ৩,০০০ টন, যা রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় অবশিষ্ট সোনার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এতদিন ভাবা হত, খনির সোনার নিরিখে অন্য বহু দেশের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে চিন। তবে পরপর এই ধারাবাহিক আবিষ্কারগুলো একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, চিনে মজুত সোনার ভান্ডার হয়তো বিশেষজ্ঞদের ধারণার চেয়েও কয়েকগুণ বড়! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাডার ব্যবস্থা এবং অত্যন্ত শক্তিশালী খনিজ সন্ধানী স্যাটেলাইট ব্যবহার করে চিন। এইবার আপনার মনে হতেই পারে যে চিন তো তাদের সব তথ্য বাইরে বেরোতে দেয় না, তাহলে তাদের টেকনোলজি সম্পর্কে জানা গেল কীভাবে? আসলে এই প্রযুক্তির প্রভাব চিনের সীমানার বাইরেও দেখা গিয়েছে ইতিমধ্যেই। জিনপিংয়ের প্রযুক্তি পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বহু অঞ্চলে নতুন সোনার খনি শনাক্ত করতে সাহায্য করেছে বারেবারে।
তবে চিনে কিন্তু এক অন্য সমস্যা দেখা গিয়েছে। এই বিপুল খনির খবর ছড়িয়ে পড়তেই আশা-আশঙ্কা, দুইই তৈরি হয়েছে ড্রাগনের দেশে। সোনার পুরোনো গয়না বিক্রি এতটা বেড়েছে, যে সোনার দাম পড়তির দিকে! ফলে আরও কয়েকশো টন সোনা রাতারাতি বাজারে এলে ঢেউয়ের ধাক্কায় সোনার দাম যে কমবে, তা স্বীকার করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তবে এই ঘটনায় ভারতের বাজারে কতটা প্রভাব পড়বে, তা দেখার জন্য আপাতত অপেক্ষা করতেই হবে!
প্রাচীন চিনা পুরাণে কুনলুন পর্বতমালা ছিল দেবতাদের পবিত্র পর্বতশ্রেণি—গ্রিক পুরাণের অলিম্পাস পর্বতের মতোই এর নাম গোটা দেশ জুড়ে। প্রাচীন চৈনিক গ্রন্থ ‘শান হাই জিং’য়ে (The Classic of Mountains and Seas) কুনলুনকে বিশ্বজগতের কেন্দ্র এবং ‘পৃথিবীর সব রত্নের ভাণ্ডার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আর আজ আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করছে—ইউরেশিয়ার ভৌগোলিক কেন্দ্র শিনজিয়াংয়ে অবস্থিত, তাই অঞ্চলটি বহু মূল্যবান খনিজে সমৃদ্ধ। তবে কুনলুন সোনা-সমৃদ্ধ—এমন প্রাচীন বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এতদিন মেলেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিনা বিজ্ঞানীরা কুনলুনের পশ্চিমাংশে অর্থাৎ কিরগিজস্তানের সীমান্তের কাছে বড় সোনার খনি থাকার ইঙ্গিত পেয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হল কুওকেজিলেগা খনি।
ভারতে কেন এত বড় সোনার খনির সন্ধান পাচ্ছি না আমরা? আসলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভূ-পৃষ্ঠ এই এলাকায় প্রচণ্ড বিকৃতি ও বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। প্রাচীন কালে জলের মাধ্যমে সোনা বাহিত হয়ে টেকটনিক প্লেটের গভীর ফাটলে প্রবেশ করত, আর ৪০ কোটি বছর পুরোনো এক বিশেষ শিলাস্তরে কোয়ার্টজ ভেইন ও ‘অল্টারেশন হ্যালো’ আকারে সোনার জমতে থাকত। গবেষকদের তথ্য বলছে, এই এলাকায় মোট ৮৭টি সোনাবহনকারী বডি (ore bodies) চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি প্রধান। খনিজের ঘনত্ব ভূ-পৃষ্ঠের প্রথম ৩০০ মিটারেই বেশি—এতে সোনা উত্তোলন তুলনামূলক সহজ।
এইবার ভাবুন, চিন কেন এত এগিয়ে? ২০১৮ সালে জিনপিংয়ের বিজ্ঞানীরা একটি বিশাল রাডার সিস্টেম তৈরি করে। এই ক্রস-আকৃতির অ্যান্টেনা অ্যারের বিস্তৃতি নিউইয়র্ক শহরের পাঁচগুণেরও বেশি। এই যন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী, নিম্ন-ফ্রিকোয়েন্সির তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ পাঠায়, যা পৃথিবীর ভূত্বকের গভীরে প্রবেশ করে চিন এবং আশপাশের অঞ্চলে কয়েক কিলোমিটার নিচ পর্যন্ত ভূগর্ভের গঠন সুনির্দিষ্টভাবে মানচিত্রায়িত করতে পারে—ফলে মাটির নিচে না ঢুকেই নিমেষে গোটা এলাকায় কী পোঁতা আছে, মুহূর্তের মধ্যে জানা যায়! এ ক্ষমতা আপাতত বিশ্বের অন্য কোনও দেশের নেই। এই প্রযুক্তিগত সুবিধা চিনকে আজ উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশের গবেষকেরা তাই শুধু সোনা নয়, লিথিয়াম, ইউরেনিয়াম, দুর্লভ ধাতু, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের অনুসন্ধানে বৈপ্লবিক অগ্রগতি অর্জন করেছেন। কবে ভারত এই চিনের এই গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনকে টেক্কা দেবে? আচ্ছা, চিনে এত সোনা পাওয়া গেলে কি ভারতে হলুদ ধাতুর দাম কমবে?