১৯৭৫ সাল। মাত্র চার বছর আগে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। আর সেই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান। এর মধ্যেই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একাংশের মধ্যে সরকারকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে অসন্তোষ। যে কোনওভাবে সরকার ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা যে শুরু হয়েছে। সেই খবর আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। শুধু সরকার ফেলে দেওয়াই নয় মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনাও শুরু হয়ে গিয়েছিল সেনার অন্দরে!
খবর ছিল ভারতের কাছে
তখন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসস উইং-এর প্রধান ছিলেন রামেশ্বর নাথ কাও। মুজিব হত্যার অনেক আগেই কাও জানিয়েছিলেন ‘র’ (RAW)-এর কাছে মুজিব হত্যার পরিকল্পনার খবর এসেছে। খবর পেয়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শ নিয়ে বাংলাদেশ গিয়েছিলেন কাও। দেখাও হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। সবটা শোনার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ওরা আমার সন্তানের মতো। ওরা আমার কোনও ক্ষতি করবে না।’
১৯৭৫ সালে আবার র-এর এক উচ্চপদস্থ কর্তাকে পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশে। আবারও সতর্ক করা হয়েছিল মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু কোনও সতর্কবার্তাতেই কান দেননি তিনি। শুধুমাত্র ভারত নয়, আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও খবর যেতে শুরু করে মুজিবের কাছে।
প্রথম হামলায় ব্যর্থ হয় আততায়ীরা
১৯৭৫ সালের ২১ মে। কাজ সেরে ধানমণ্ডির বাড়িতে ফিরছিলেন মুজিবর রহমান। গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল তাঁকে। তবে মুজিবের গায়ে কোনও আঁচড় লাগেনি সে বার। দুজন আহত হয়েছিলেন। ওই বছরেরই ১৬ই মার্চ। মুজিবের জন্মদিনের ঠিক আগেই ঢাকার তিনটি জায়গায় পরপর বোমা বিস্ফোরণ হয়। সেটাও হত্যার প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে মনে করেছিল আমেরিকা।
১৫ অগস্ট আর কোনও ভুল হয়নি
সেদিন সকালে চারটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল আততায়ীরা। সোমবার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর ধানমণ্ডির যে বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর ও লুঠপাট চালানো হয়েছে, সেই বাড়িতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট হত্যা করা হয়েছিল মুজিবর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের।
সেদিন রাতে একই ঘরে শুয়ে ছিলেন মুজিবর রহমান, তাঁর স্ত্রী বেগম মুজিব ও তাঁদের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল। তিনতলার একটি ঘরে শুয়ে ছিলেন তাঁরা। চার তলায় ছিলেন মুজিব-পুত্র কামাল ও তাঁর স্ত্রী সুলতানা কামাল। তিন তলাতেই ছিলেন আর এক পুত্র জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজি। মুজিবের ঘরের ঠিক সামনে ব্যালকনিতে শুয়েছিলেন বাড়ির দুই পরিচারক রোমা ও সেলিম। এছাড়া একেবারে নীচের তলায় ছিলেন বেশ কয়েকজন কর্মী।
ভোরের আলো ফুটতেই….
ঘড়িতে তখন ঠিক ভোর পাঁচটা। হঠাৎ দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন মুজিবের স্ত্রী বেগম মুজিব। পরিচারক রোমাকে তিনি জানান, তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে হামলা হয়েছে। এ কথা শুনে রোমা সোজা ছুটে যান বাড়ির সামনের দিকে। তাকিয়ে দেখেন, গুলি চালাতে চালাতে কয়েকজন এগিয়ে আসছে বাড়ি লক্ষ্য করে। রোমা তখন একে একে বাড়ির সব সদস্যদের ঘুম থেকে তুলে জানাচ্ছেন হামলার কথা। শেখ কামাল, জামাল প্রত্যেকে একে একে নীচে নেমে আসছেন। আপ্তসহায়কের সঙ্গে কথা বলতে ততক্ষণে রিসেপশনে চলে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। হঠাৎ গুলির শব্দ, আর শেখ কামালের আর্তনাদ…।
ছেলের কণ্ঠস্বর শোনার পর বঙ্গবন্ধু সোজা চলে যায় নিজের ঘরে। বন্ধ করে দেন দরজা। বন্ধ হয়ে যায় গুলির শব্দ। মুজিবর রহমান সোজা বেরিয়ে আসেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে ঘিরে ফেলে আততায়ীরা। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেন, “তোমরা কী চাও? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?”
তাঁকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে আততায়ীরা। দু-তিন ধাপ নামার পরেই নীচ থেকে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে চালানো হয় গুলি। সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়ে তাঁর রক্তাক্ত দেহ।
পরিবারের সদস্যরা ততক্ষণে লুকিয়েছেন মুজিবের ঘরের বাথরুমে। মুজিবর রহমানের ভাই শেখ নাসেরের হাতে গুলি লেগেছে। শাড়িতে তাঁর হাতে বেঁধে দিচ্ছেন বেগম মুজিব। ততক্ষণে আবার তিনতলায় চলে এসেছে আততায়ীরা। জোরে দরজা ধাক্কাতে থাকে তারা।
একে একে সবাইকে শেষ করে দেওয়া হয়…
আততায়ীরা প্রত্যেককে বাথরুম থেকে বের করে নীচের তলায় নিয়ে যায়। সিঁড়ি থেকে নামার সময় মুজিবের স্ত্রী দেখেন পড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর দেহ। তিনি বলে ওঠেন, ‘আমি আর কোথাও যাব না, মেরে ফেল আমাকে।’ তারপরেই তাঁকে ঘরের ভিতর নিয়ে যাওয়া হয়। আরও একটা গুলির শব্দ…।
মুজিবের ১০ বছরের ছেলে রাসেলকেও ছাড়া হয়নি । এমন পরিস্থিতির মাঝে ততক্ষণে সে প্রবল ভয় পেয়ে গিয়েছে। বারবার কাঁদছে আর বলছে আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চল। এ কথা শুনে তার হাত ধরে আততায়ীরা বলে, চল তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাব।
এরপর তাকে নিয়ে যায় সেই ঘরে গিয়ে যেখানে রাসেল কেউ গুলি করে দেয় তারা। শেখ মুজিবুর রহমানের ভাই, এই পরিচয় পাওয়ার পর আর অপেক্ষা করেনি সোজা বাথরুমে নিয়ে গিয়ে গুলি করে দেওয়া হয় তাকে। এরপর মুজিবের বাড়ির সামনে এসে থামে একটি সেনা ট্যাঙ্ক। মেয়ে যখন বেশ কয়েকজন এগিয়ে এসেছে জিজ্ঞেস করে ভিতরে কি হয়েছে, ভিতর থেকে উত্তর যায় সবাই শেষ।
(পরিচারক রোমা পরবর্তীতে আদালতে যে বয়ান দিয়েছিলেন, তা থেকেই সামনে আসে সেদিনের আসল ঘটনা)