ইংল্যান্ড: গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত জায়গাটা। অদ্ভুত থমথমে। শিরশিরে হওয়া কানের পাশ দিয়ে যেন শিস দিয়ে যায়। মৃদু সেই হওয়ায় বারে বারে সরসর করে সরে যায় পড়ে থাকা গাছের পাতা। তার মাঝেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। জীর্ণ, প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত। একসময় এটাই ছিল ঝাঁ চকচকে মানসিক হাসপাতাল। ঘটনার কেন্দ্র এই হাসপাতাল নিয়ে প্রচার নেহাত কম নয়। প্রেতাত্মা, খুন……রোমহর্ষক ঘটনার সেই প্রচার আজও ঘুরে বেড়ায় ইংল্যান্ডের ইস্ট সাসেক্সের হেলিংলে হাসপাতাল নিয়ে।
দিনটা ১৯০৩ সালের ২০ জুলাই। বেশ সাজ সাজ রব হেলিংলেজুড়ে। অত্যাধুনিক মানসিক হাসপাতালে তৈরি হয়েছে সেখানে। যার উদ্বোধন ছিল সেদিন। হেলিংলের এই নবগঠিত হাসপাতালের স্থপতি ছিলেন জর্জ টমাস হাইন। সেসময়কার ইংল্যান্ডের এক জন বিখ্যাত স্থপতি হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁর। বলাই বাহুল্য, অত্যাধুনিক হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলে তার তৈরি হাসপাতালটি। ভিতরে নিজস্ব ট্রেন লাইন, ট্রাম চলাচলের ব্যবস্থা, লিঙ্গভিত্তিক থাকার ব্যবস্থা, সেলাইয়ের ঘর কী ছিল না সেই হাসপাতালে। তবে ট্রাম আর রেলপথ মিলিয়ে বাকি হাসপাতালগুলির নিরিখে চ্যাম্পিয়ন ছিল এটি। অত্যন্ত দক্ষ চিকিৎসক ও তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি হাসপাতালের সুখ্যাতি ইংল্যান্ড জোড়া করে তোলে। প্রচারের আলোয় আসে চিকিৎসকদের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যদিও সেই সমস্ত পরীক্ষাকে কেউ কেউ ‘অদ্ভুত’ আখ্যা দিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন। তবে এতে খ্যাতি কমেনি হেলিংলের। বরং ওয়েস্ট সাসেক্স হাসপাতাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু রোগী চলে আসেন এখানে। এক সময় জনপ্রিয়তা এতটাই শিখরে পৌঁছে যায় যে ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডের সেরা ৫টি মানসিক হাসপাতালের মধ্যে নিজেদের দক্ষতায় সেরার শিরোপা তুলে নেয় হেলিংলে।
কিন্তু অন্ধকার নামে এই সময় থেকে ঠিক দশ বছর পর। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সাড়া জাগানো হেলিংলে। বেশ কয়েকটি কারণ উঠে আসে। তার মধ্যে অন্যতম কর্তৃপক্ষের তরফে হঠাৎ হাসপাতালের খরচ বাড়িয়ে দেওয়া। ফলে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেন। এরই প্রভাবে ধীরে ধীরে কমতে থাকে রোগীর সংখ্যা। শেষমেশ বন্ধ করে দিতে হয় হাসপাতালটি। তবে অনেকেই এই কারণকে সিলমোহর দিতে চান না। আর তার থেকেই পথ চলা শুরু রহস্যের। শুরু প্রচারের। তবে হাসপাতাল বন্ধু হয়ে যাওয়ায় অনেক রোগীকেই ‘সুস্থ’ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। যারা মোটেও সুস্থ ছিলেন না। এই সমস্ত রোগীরা নাকি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। বরং হাসপাতাল থেকে ফিরে খুনের মত গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
খুনের পাশাপাশি তারা নাকি জড়িয়ে পড়তেন অন্যান্য অপরাধমূলক ঘটনাতেও। এছাড়াও অন্য আরও একটি মত প্রচলিত ছিল। তা অনুযায়ী, ভুল চিকিৎসার কারণে অনেকেই অকালে প্রাণ হারান হাসপাতালটিতে। তাদের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়াতে শুরু করে বিরাট ভবনের আলো-আঁধারি মেশানো গলিতে। অনেকেই অনুভব করতেন অশরীরীদের এই চলাফেরা। ফলত বন্ধ করা ছাড়া আর উপায় ছিল না।
তবে এছাড়াও আরও একটি তত্ত্ব খাড়া করা হয়। কিছু মানুষ অবশ্য দাবী করেছিলেন, রোগীদের সুস্থ করতে বিভিন্নরকম শারীরিক অত্যাচার করা হতো। বিদ্যুতের শক দেওয়া হতো তাদের। অর্থাৎ নিষিদ্ধ চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল হাসপাতালের বিরুদ্ধে। তবে ঘটনা যাই হোক, আজও হেলিংলে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝেমধ্যে চুরি এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। হয়েছে অগ্নিকাণ্ডও। সব মিলিয়ে আরও থমথমে হয়েছে হাসপাতাল চত্বর। মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়া রোগীদের প্রচারিত থাক বা না থাক, দিনের বেলাতেও সেই হাসপাতাল চত্বরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যেতে পারে আপনারও।