
দিনে দিনে বাড়ছে গরম। বাড়ছে জলবায়ুর অস্থিরতা। এমতাবস্থায় কাঁটা হয়ে দেখা দিচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। জানেন, এসবের মূলে কিন্তু রয়েছে আমাদের একাধিক ভুল পদক্ষেপ। ভারত-সহ বেশ কয়েকটি দেশ করছে এমন একটি কাজ, যার জেরে পৃথিবীর ভারসাম্য বিগড়ে যাচ্ছে অচিরেই! নিজের অক্ষ থেকেই নাকি সরে যাচ্ছে পৃথিবী। বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত সতর্ক করছেন এই সমস্যা নিয়ে। এই অবস্থা চলতে থাকলে প্রভাব হবে সাংঘাতিক। আর ভুগতে হবে গোটা মানবজাতিকেই!
পার্থিব জীবজগতে জলই জীবন। বেঁচে থাকার জন্য এই একটি উপাদানের উপর নির্ভরতা কেবল মানুষ নয়, অন্যান্য সকল জীবেরই। পানের উপযোগী জল বলতে একটাই―ভূগর্ভস্থ জল। আর এখানেই দানা বাঁধছে সমস্যা! ভূগর্ভস্থ জলের বেহিসেবি উত্তোলনের কারণেই অক্ষ থেকে সরে গিয়েছে পৃথিবী। কী ভাবছেন, পৃথিবী অক্ষ থেকে সরে গেলেও তো আর সূর্যের চারপাশে ঘোরা থামায়নি―তাহলে সমস্যা হবে কীভাবে?
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, অক্ষ থেকে পৃথিবীর এই বিচ্যুতিতে শুধু রাত-দিনের উপরেই যে প্রভাব পড়বে এমনটা নয়, বরং জল থেকে শুরু করে আমাদের খাবার-দাবারের উপরেও খারাপ প্রভাব পড়বে। এমনকি খাদ্যের অভাব দেখা দেওয়াটাও অমূলক নয়। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের কয়েকটি আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, এই সমস্যার জেরে রোগের প্রকোপও বাড়তে পারে দ্রুতগতিতে। রিপোর্ট বলছে, সারা বিশ্বজুড়ে ভূগর্ভ থেকে যতটা জল তোলা হচ্ছে, ২৫ শতাংশেরও বেশি শুধু ভারতেই। অন্যান্য দেশে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার অধিকতর হলেও ভারতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত জল উত্তোলন হয়। ফলত বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিগড়ে যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আপামর ভারতবাসীর গোটা জীবনধারণের কাঠামোটাই!
সহজভাবে বললে, পৃথিবী একটি ঘূর্ণায়মান বলের মতো। যদি এর ভরের বণ্টন পরিবর্তিত হয়, তাহলে এর ঘূর্ণনের অক্ষও পরিবর্তিত হয় বা সরে যায়। এই ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘পোলার মোশন’ বলা হয়। তথ্য বলছে, গত ১৭ বছরে অনেক কিছু বিঘ্নিত হয়েছে পৃথিবীতে। সবচেয়ে বেশি ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করেছে ভারত। তারপরে যথাক্রমে চিন এবং আমেরিকা। এখানেই আসল ট্যুইস্ট। কেন এই অক্ষবিচ্যুতিতে ভারতের নাম আসছে বারংবার, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছে তথ্য।
সাম্প্রতিক তথ্যাবলী অনুসারে, ভারত প্রতি বছর ২৫০–২৬০ কিউবিক কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেয়। যা আমেরিকা এবং চিনের যৌথ ব্যবহারের চেয়েও অনেকটা বেশি। পৃথিবীর ১০ শীর্ষ গ্রাউন্ডওয়াটার ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রথম স্থানে ভারত, তারপরে থাকা চিনে বার্ষিক ১১২ কিউবিক কিলোমিটার মাটির তলার জল তোলা হয়, যা ভারতের সংখ্যার অর্ধেকেরও কম। আমেরিকার ক্ষেত্রে পরিমাণটা হল বার্ষিক ১১১ কিউবিক কিলোমিটার।
পৃথিবী নিজ অক্ষ থেকে সরে গেলে তার আহ্নিক ও বার্ষিক গতি প্রভাবিত হবে। ফলত নেমে আসবে একাধিক সঙ্কট। ঋতু পরিবর্তন দ্রুত হবে। গ্রীষ্ম-শীতের সময়কাল পরিবর্তিত হবে ঘনঘন। বরফ দ্রুত গলবে। ভারতবর্ষের মতো দেশে মৌসুমী বায়ুর আনাগোনার দিনকাল বিঘ্নিত হতে পারে, ফলে খরা বা অতিরিক্ত বৃষ্টি হতে পারে প্রায় প্রতি বছরই। এমনকি সমুদ্র স্তর এবং উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভূত প্রভাব পড়বে। জার্মানির মিউনিখের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী উলরিখ স্ক্রিবার সাফ জানিয়েছেন, বেশ কিছু ভৌগোলিক এবং পরিবেশগত কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আহ্নিক গতির প্রকৃতি, ফলত আগামীতে সুনামি বা অগ্ন্যুৎপাতের আকস্মিক সংখ্যাবৃদ্ধি দেখতে চলেছে আপামর মর্ত্যবাসী।
পৃথিবীর অক্ষ এভাবে বেঁকে গেলে ক্ষতি হবে আরও। তালিকায় রয়েছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলার মতো ভয়াবহ বিষয়ও! বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে এমনিতেই মহাসাগরের জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতি বছর। ভূগর্ভস্থ জল এভাবে তুলে নিলে আগামীতে গ্রিনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকার বরফ দ্রুত গলবে। সমুদ্র স্তরের বৃদ্ধি এভাবে হলে আগামী ১০ বছরে মুম্বই, কলকাতা থেকে বাংলাদেশ―উপকূলীয় শহর ও দেশ ডুবে যেতে পারে। আটলান্টিকের গালফ স্ট্রিম বরাবর যে প্রবাহ, তা প্রভাবিত হবে, ফলে ইউরোপের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যেতে পারে। যদিও সামুদ্রিক স্রোতের প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের তাপমাত্রার হেরফের কতটা হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য মেলেনি। ফলত ‘বাংলার তাপমাত্রাও কি কমবে’ বা ‘কলকাতাতেও বরফ পড়বে’―এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি।
ভূবিজ্ঞানীরা যে রিপোর্ট পেশ করেছেন, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে ভূমিকম্প বেশি হবে এবং আগ্নেয়গিরিতে অগ্নুত্পাত বাড়বে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে চাপ পরিবর্তিত হওয়ার দরুণ টেকটোনিক প্লেট সক্রিয় হতে পারে। প্রশান্ত অঞ্চলের ‘রিং অফ ফায়ার’-এ বেশি ভূমিকম্প হতে পারে। সমুদ্রের তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে বেশি হ্যারিকেন-সাইক্লোনের ন্যায় শক্তিশালী ঝড় দেখা দেবে মাঝেমধ্যেই! আচ্ছা, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে―গত ২ বছরে যে পরিমাণ টর্নেডো দেখেছে পশ্চিমবঙ্গবাসী, তা কি আগেও দেখেছেন? মনে পড়ে?
তবে এতগুলো খারাপ খবরের মাঝেও স্বস্তি একটাই। তাৎক্ষণিক বিপদ এখনই নেই। বর্তমানে অক্ষ সরে যাওয়ার গতি খুব ধীর অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় ১০ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। এই ঘটনার গুরুতর প্রভাবকে স্পষ্টভাবে বুঝতে শত শত বছর লাগবে। তবে চিন্তার বিষয় একটাই, ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং বরফ গলে যাওয়া এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে অনেকটাই। সহজভাবে ভেবে দেখুন, দৈনন্দিন কাজের জন্য কত শত লিটার জল আপনি এমনিই নষ্ট করেন! বাড়ির বারান্দাটাকে আর একটু প্রশস্ত করতে হয়তো কেটে ফেললেন ৫০ বছর পুরোনো একটি গাছ, বদলে আপনার আদরের বারান্দায় শোভা পাচ্ছে ছোট্ট টবে বসানো বাহারি লতারা। কী মনে হয়? সুস্থভাবে বাঁচতে পারবেন ১০ বছর পর?