
৬ জুলাই তাঁর ৯০ তম জন্মদিন। তিনি, হিজ হোলিনেস দ্য ফোরটিনথ দলাই লামাকে নিয়ে এখন একটাই প্রশ্ন। চতুর্দশ দলাই লামার পরে কে? অর্থাত্ তার পরে তিব্বতের সর্বোচ্চ নেতার পদে বসবেন কে? দলাই্ তেনজিং গ্যাস্ট্রো কি নিজেই নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করে যাবেন? ৯০ তম জন্মদিনের আগে দলাই এব্যাপারে প্রথমবার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। আর তার ঠিক পরপরই মাঠে নামে চিন। চিনের দেখাদেখি ভারতকেও নামতে হল। বৃহস্পতিবার ধর্মশালায় দলাই লামা আশ্রমে দাঁড়িয়েই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু বলে দিলেন, দলাই লামার উত্তরাধিকার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এক দলাই ছাড়া অন্য কারও নেই। রিজিজু বললেন, ‘দলাই লামার উত্তরাধিকার তিব্বতীদের বিশ্বাস আর আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দলাই লামার ভক্তদের জন্যও সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এনিয়ে আমাদের অবস্থা একই আছে, এবং থাকবে। উত্তরাধিকার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র দলাই লামাই নিতে পারেন। এবার তিব্বতিদের রীতি মেনেই উত্তরাধিকার বাছাই হবে।’
ভারত এমনি এমনি এই মন্তব্য করেনি। দলাইয়ের উত্তরাধিকার আসার পরই কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল চিন। সম্প্রতি চিনা বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিং দাবি করেছিলেন, দলাইয়ের উত্তরাধিকারের সিদ্ধান্ত চিনকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। চিনের আইন ও রীতিনীতি মেনেই মনোনয়ন হতে হবে। চিনের এই বক্তব্যে উড়িয়েই ধর্মশালা থেকে বার্তা দিলেন কিরেণ রিজিজুর মতো হেভিওয়েট মন্ত্রী। মোদ্দা কথায় ভারতের অবস্থানই তুলে ধরলেন অরুণাচলের ভূমিপুত্র ও সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী। অরুণাচল, চিন যাকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে, সেখান থেকে রিজিজুর এই বার্তা। বোঝাই যাচ্ছে, ভারত ধরেই নিয়েছে, এই বিষয়টা অনেক দূর গড়াবে। এবং সরকার প্রথম থেকেই এব্যাপারে কড়া অবস্থান নেবে।
দলাই লামার মনোনয়ন নিয়ে মূলত তিনটে কারণে ভারত-চিন সংঘাতের সম্ভাবনা। প্রথমত, তিব্বতের সর্বোচ্চ নেতার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা গেলে তিব্বতীদের বড় অংশের সমর্থন নিশ্চিত হবে। দুই, দলাই ভারতের দিকে ঝুঁকলে তিব্বতে এমনকি তিব্বত ইস্যুতে চিনের প্রভাব কমবে। তৃতীয়ত, দলাইকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক স্তরে তিব্বত নিয়ে নিজেদের অবস্থান জোরদার করার সুযোগ করতে চায় ভারত-চিন। তিব্বত নিয়ে ভারতের একটাই উদ্দেশ্য। চিনকে চাপে রাখা। চিনের কিন্তু একাধিক স্বার্থ তিব্বতে জড়িয়ে। আর তাই উত্তরসূরি নিয়ে এত চাপানউতোর।
গত মঙ্গলবার দলাই জানিয়েছিলেন, তার তৈরি ফোড্রং ট্রাস্ট তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এখানে অন্য কারওর ভূমিকা থাকবে না। ভারত মনে করছে, দলাই লামা নিজের উত্তরসূরী নির্বাচন করে উইল করেছেন। সেই উইল এখন ফোড্রং ট্রাস্টের হেফাজতে। বিবিসির প্রতিবেদনে দাবি, এবার আর কোনও শিশু বা কিশোর নয়, এক তরুণ গবেষককে দলাই লামা হিসাবে দেখা যাবে। ২০১৯ সালে দলাই জানিয়েছিলেন, পরবর্তী দলাই লামা বাছাই ভারত থেকে হবে। এর পর থেকেই দলাই লামার উত্তরসূরি নিয়ে তত্পরতা বাড়িয়ে দেয় চিন। ২০২৩ এবং ২০২৪ – পরপর দু-বার পাঞ্চেন লামার সঙ্গে বৈঠক করেন চিনের একাধিক নেতা-মন্ত্রী। দলাইপন্থীরা কোনওদিনই পাঞ্চেন লামাকে স্বীকৃতি দেয়না। তাদের অভিযোগ, পাঞ্চেন লামা, বেজিংয়ের তৈরি করা পুতুল ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ তিব্বতিদের মধ্যেই পাঞ্চেনের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই চিনের এখন একটাই টার্গেট। যেনতেন প্রকারে নতুন দলাই লামা মনোনয়নে প্রভাবব খাটানো। এতে তিব্বতের উপর চিনের প্রভাব আরও শক্তপোক্ত হবে বলেই চিনের ধারণা। ১৯৫৯ সালে স্বাধীন তিব্বতে চিনা সেনা যখন অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে, তখন ছদ্মবেশে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তেনজিং গ্যাস্ট্রো। ভারত থেকে তিব্বতের স্বাধীনতার দাবি তুলেছিলেন। সেই থেকেই চিনের সঙ্গে তাঁর সংঘাত। কয়েক বছর হল, তিব্বতের স্বাধীনতার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন দলাই। তবুও ৯০ বছরের ধর্মীয় নেতাকে বিশ্বাস করতে রাজি নয় বেইজিং।