ওয়েনাড: “এল্লোরম কংগ্রেসিক্কু ভোট পোডুঙ্গাল”। ১৯৯৮ সালে নির্বাচনী ময়দানে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন সনিয়া গান্ধী, কিন্তু সকলের মন জয় করেছিল তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কন্যা প্রিয়ঙ্কার এই আর্জি। তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারে ঝড় তুলেছিলেন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। তখন বয়স ২৬ বছর। কংগ্রেস সমর্থকরা সেদিন স্লোগান দিয়েছিলেন, “আমাদের ভবিষ্যত নেত্রী”। তারপর থেকে রাজনীতির ময়দানে পরিচিত প্রিয়ঙ্কা। তাঁর মধ্যে অনেকে ইন্দিরার ছায়াও দেখেন। তবে সক্রিয় রাজনীতিতে থাকলেও, ভোটের লড়াইয়ে নামতে প্রিয়ঙ্কার সময় লেগে গেল ৩৫ বছর। আর প্রথম লড়াইয়েই ভিকট্রি। লোকসভা উপনির্বাচনে ৪ লক্ষেরও বেশি ভোটে ওয়েনাড কেন্দ্র থেকে জয়ী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। দাদা রাহুল গান্ধীর রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন প্রিয়ঙ্কা। জয় যদি এতই সহজ ছিল, তাহলে ৩৫ বছর সময় কেন নিলেন প্রিয়ঙ্কা?
প্রিয়ঙ্কার রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু হয়েছিল মাত্র ১৭ বছর বয়সে, বাবা রাজীব গান্ধীর ছত্রছায়ায়। ১৯৮৯ সালে মায়ের হয়ে প্রথম প্রচার। তারপর ২০০৪ সালে যখন রাহুল গান্ধী রাজনীতির ময়দানে পা রাখলেন, তখনও পাশে দাঁড়িয়ে প্রচার করেছিলেন প্রিয়ঙ্কাই।
৫২ বছর বয়সে প্রথম নির্বাচনী পরীক্ষা দিলেন প্রিয়ঙ্কা। ওয়েনাডে নবাগত হলেও, প্রিয়ঙ্কা যে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ, সে বিষয়ে কোনও অবকাশ নেই। কংগ্রেসে ভাঙন রুখতেই হোক কিংবা অন্য কোনও দলের সঙ্গে জোট বাধা, যখন সনিয়া-রাহুল ব্যর্থ হয়েছেন, তখন হাল ধরেছেন প্রিয়ঙ্কাই। কখনও রাহুলের হয়ে প্রচার করেছেন, কখনও মা সনিয়া গান্ধীর হয়ে প্রচার করেছেন প্রিয়ঙ্কা। কিন্তু এবার নিজের জন্য প্রচার করলেন প্রিয়ঙ্কা।
ওয়েনাডে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে প্রিয়ঙ্কা গান্ধী এই কথাই বলেছিলেন। “১৭ বছর বয়সে, ১৯৮৯ সালে আমি প্রথমবার আমার বাবার হয়ে নির্বাচনী প্রচার করেছিলাম। ৩৫ বছর হয়ে গিয়েছে। আমি নিজের মা, বাবা, দাদা ও বহু সহকর্মীদের জন্য প্রচার করেছি। কিন্তু এই প্রথম আমি নিজের জন্য প্রচার করছি।”
প্রথম পরীক্ষাতেই সফল প্রিয়ঙ্কা। ওয়েনাড উপনির্বাচনে ৪ লক্ষেরও বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছেন প্রিয়ঙ্কা। জয় নিশ্চিত। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাহুল ওয়েনাড কেন্দ্র থেকে ৩ লক্ষ ৬৪ হাজার ৪২২ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। অর্থাৎ রাহুলের রেকর্ডকেও ভেঙে দিলেন প্রিয়ঙ্কা।
My dearest sisters and brothers of Wayanad,
I am overwhelmed with gratitude for the trust you have placed in me. I will make sure that over time, you truly feel this victory has been your victory and the person you chose to represent you understands your hopes and dreams and…— Priyanka Gandhi Vadra (@priyankagandhi) November 23, 2024
প্রিয়ঙ্কার মধ্য়ে কংগ্রেস কর্মীরা বরাবরই ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া দেখেছেন। চেহারায় যেমন মিল, তেমনই রাজনীতির ময়দানেও প্রিয়ঙ্কার মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর স্বভাব-চরিত্রের একাধিক মিল দেখতে পান। ইন্দিরা গান্ধী যেমন দক্ষ রাজনীতিবিদ ছিলেন, প্রিয়ঙ্কাও দীর্ঘ কেরিয়ারে বারেবারে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। সচিন গেহলটের মান ভাঙানো থেকে শুরু করে অখিলেশের সঙ্গে আসন রফা, সবেতেই কাজ করেছিল প্রিয়ঙ্কার বুদ্ধিমত্তা ও বাগ্মিতা।
প্রিয়ঙ্কা নিজেকে দক্ষ সাংগঠনিক হিসাবে প্রমাণ করলেও, কংগ্রেস তাঁকে নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক ছিল। “দ্বিতীয় ইন্দিরা গান্ধী” হিসাবে প্রিয়ঙ্কাকে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও, তা ব্যর্থ হওয়ার ভয়ে পিছিয়ে এসেছে। প্রিয়ঙ্কাকে ভোটের রাজনীতিতে সামিল করার চেষ্টা কংগ্রেস বহুদিন ধরেই করছে। ২০০৪ সালে রাহুল নির্বাচনে আত্মপ্রকাশ করলেও, প্রিয়ঙ্কা সেই সময় নেপথ্যের কারিগর ছিলেন। উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বহুবারই জল্পনা শোনা গিয়েছে যে কংগ্রেসের গড় হিসাবে পরিচিত আমেঠী বা রায়বরৈলি থেকে ভোটে দাঁড়াতে পারেন প্রিয়ঙ্কা। এমনকী, ২০১৯ সালে প্রায় নিশ্চিত ছিল যে বারাণসী কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হচ্ছেন প্রিয়ঙ্কা। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। প্রার্থী হন অজয় রাই। উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন প্রিয়ঙ্কা। মহিলা ভোট টানতে সদর্থক ভূমিকাও পালন করেছিলেন।
এরপরে ২০২১ সালে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও শোনা গিয়েছিল, কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হতে পারেন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। সেই জল্পনাতেও জল ঢেলে দেন প্রিয়ঙ্কা নিজেই। জানান, এখনই নির্বাচনে দাঁড়াতে চান না তিনি। সমালোচকরা সেই সময় বলেছিলেন, রাজনীতিতে থাকলেও, হারার ভয় পান প্রিয়ঙ্কা। সেই কারণে কখনও ভোটে লড়েন না।
কাট টু ২০২৪। সনিয়া গান্ধী রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে যান। রায়বরৈলি আসন, যেখান থেকে বরাবর নির্বাচনে দাঁড়ান, তা শূন্য পড়েছিল। এই আসনে কে দাঁড়াবেন, তা নিয়ে জোর জল্পনা ছিল। রাহুল গান্ধী ২০১৪ ও ২০১৯ সালে আমেঠী থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। এবারও আমেঠীতেই প্রার্থী হবেন বলে আশা করা হয়েছিল। প্রিয়ঙ্কা তাহলে দাঁড়াতেন রায়বরৈলিতে। কিন্তু সেই হিসাবও ওলট-পালট হয়ে যায়। রাহুল গান্ধী প্রার্থী হন ওয়েনাড ও রায়বরৈলী থেকে। এবং দুই কেন্দ্রেই জয়ী হন।
দুই আসনে তো সাংসদ থাকতে পারেন না রাহুল গান্ধী। কংগ্রেসের অন্দরে শোনা যাচ্ছিল, রায়বরৈলি আসন ছেড়ে দেবেন রাহুল। সেই আসনেই দাঁড়াবেন প্রিয়ঙ্কা। তবে এখানেও হিসাব উল্টে গেল। দক্ষিণে ভরসার আসন ওয়েনাড ছেড়ে দিলেন রাহুল।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আত্মপ্রকাশ না করতে পারলেও, উপ-নির্বাচনেই ভোটের ময়দানে পা রাখলেন প্রিয়ঙ্কা। দাদা রাহুল পাশে ছিলেন। কার্যত তাঁর ছত্রছায়াতেই ভোটের ময়দানে পা রাখার সাহস দেখালেন প্রিয়ঙ্কা। এবারও কম ঝুঁকি ছিল না। ভোটের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম ওয়েনাডে। তাও রেকর্ড ভোটে জয়ী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। সমালোচকদের মুখে ছাই দিতে পারলেন অবশেষে। প্রমাণ করলেন, লড়তে ভয় পান না। তা সে রাজনীতির প্রচারে হোক বা নির্বাচনের মাঠে। একইসঙ্গে আরও একবার প্রমাণ হল, কংগ্রেস গান্ধী পরিবার সর্বস্ব। ইন্দিরা গান্ধীর থেকে সনিয়া গান্ধী, তাঁর থেকে রাহুল গান্ধীর হাতে কংগ্রেসের ব্যাটন এসেছে। এবার প্রিয়ঙ্কার জয়ে দলের সামনে আরও একটি রাস্তা খুলে গেল। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি পদে কে বসবেন, তা নিয়ে টানাপোড়েন চলে বরাবর, এবার তাতে নতুন মুখ হলেন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী।