ব্রিগেড-বৃত্তান্ত: ফেলে আসা ইতিহাস

সপ্তম বামফ্রন্ট তৈরির লক্ষ্যে বামেদের ব্রিগেড (LEFT Brigade Rally)। ওই জনসভায় শেষ বারের জন্য ব্রিগেডে এসেছিলেন জ্যোতি বসু (Jyoti Basu)।

ব্রিগেড-বৃত্তান্ত: ফেলে আসা ইতিহাস
ছবি - TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Feb 28, 2021 | 2:42 PM

কলকাতা: ব্রিগেড। কলকাতার এক বিশাল সবুজায়তন। ঘাসে ভরা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। আর তার চার পাশে ব্যারিকেডের মতো দাঁড়িয়ে শিমুল, পলাশ, অশ্বত্থ। পাশ দিয়ে নদীর মতো বয়ে গিয়েছে ট্রামলাইন। ডান হাতে গঙ্গা। নাক বরাবর ভিক্টোরিয়া। বাঁ দিকে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম। খিদিরপুরের দিকে যেতে কিছুটা এগোলেই রেস কোর্স। আর পিছনে শহিদ মিনার, ইডেন গার্ডেন্স এবং রাজভবন। ভৌগলিক মানচিত্রে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড এটাই। তবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এর গুরুত্ব ভিন্ন। ব্যপ্তিও বিরাট।

ভারতীয় সেনার সম্পত্তি এই মাঠ আসলে বঙ্গ রাজনীতির সর্বকালের সেরা রাজনৈতিক মঞ্চ (Kolkata Brigade Rally)। আজ থেকে নয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই ব্রিগেডের এই মাঠ হয়ে থেকেছে জনতার দরবার।

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (Aristotle) তাঁর বিখ্যাত গণজ্ঞাপন তত্ত্বে উপলক্ষ, বক্তা, বক্তব্য, দর্শক-শ্রোতা এবং প্রভাব, এই পাঁচ উপাদানের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। যার মূল বক্তব্য, কোনও একটি উপলক্ষকে সামনে রেখে কোনও বক্তা তাঁর নির্দিষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। অ্যারিস্টটলের এই তত্ত্ব গণজ্ঞাপনের সবথেকে আদি এবং যুগান্তকারী দর্শন।

আরও পড়ুন: ব্রিগেডে ‘বলবেন’ বুদ্ধ

২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডে জনসভা করছে বাম-কংগ্রেস ও ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের জোট। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটাই কার্যত কলকাতার রাজনৈতিক মেগা শো গুলোর মধ্যে প্রথম। এরপর এখানেই জনসভা করবেন নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi)। সব শেষে সম্ভবত ব্রিগেডে জনসভা করতে দেখা যাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। ধারে ও ভারে ব্রিগেড সবসময়ই সবার থেকে এগিয়ে। শক্তি পরীক্ষায় ব্রিগেডের ‘টাক’ ভরিয়েই সর্বদা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন রাজনৈতিক যুযুধানরা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ব্রিগেডের জনসভা আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গরাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং জনসমর্থন প্রদর্শনের সেরা মঞ্চ। সমকাল তো বটেই অতীতেও এই ব্রিগেড তার গুরুত্বের দৃষ্টান্ত রেখেছে একইভাবে।

 

 

সাল ১৯৫৫ – পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এই ব্রিগেডে এসে বক্তৃতা পেশ করেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্র প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ। একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার আরও এক রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই বুলগানিন। উল্লেখযোগ্যভাবে সেদিন একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও। স্বাধীনভারতে সেদিনই প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা রেখেছিলেন ভিন দেশের কোনও রাষ্ট্রনেতা।

Brigade History

নিকিতা ক্রুশ্চেভ

সাল ১৯৭২ – ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। বাংলাদেশ- ভাষার নামে নামকরণ হল নতুন দেশের। সেই দেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানও (Sheikh Mujibur Rahman) কলকাতায় এসে ব্রিগেডে বক্তব্য পেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেদিন ব্রিগেডে সভা করেছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আয়োজক- পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতি পরিসরে ইন্দিরা-মুজিবের সেই যৌথ জনসভার যে অপরিসীম তাৎপর্য ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Mujibur Rahaman in Brigade

ব্রিগেডে মুজিব

সাল ১৯৯২ – সাতাত্তরে ক্ষমতায় এসে দেড় দশক পশ্চিমবঙ্গে তখন সিপিএম শাসন। ক্ষমতার একেবারে মধ্য গগণে বামফ্রন্ট। অন্যদিকে বিরোধী হিসেবে একটু একটু করে জমি তৈরি করছেন ‘বাংলার অগ্নিকন্যা’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন অবশ্য তৃণমূলের জন্ম হয়নি। যুব কংগ্রেসের নেত্রী এই ব্রিগেড থেকে বাজিয়েছিলেন ‘বামফ্রন্টের মৃত্যু ঘণ্টা’। বঙ্গ রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) ব্রিগেডের এই সভা বহুল চর্চিত।
মমতার এই সভার ৪ দিনের মাথায় পাল্টা সভা ডেকে সাংগঠনিক শক্তির পরীক্ষা দিয়েছিল সিপিএম (CPIM)।

mamata banerjee in Brigade 1992

১৯৯২, ব্রিগেডে মমতা

সাল ২০০৬ – সপ্তম বামফ্রন্ট তৈরির লক্ষ্যে বামেদের ব্রিগেড (LEFT Brigade Rally)। ওই জনসভায় শেষ বারের জন্য ব্রিগেডে এসেছিলেন জ্যোতি বসু (Jyoti Basu)।

jyoti basu's last brigade in 2006

জ্যোতি বসু

সাল ২০১১ – ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ২১শে জুলাই পালন। সেবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শহিদ স্মরণ করেছিলেন ব্রিগেডের মাঠে। সেভাবে কোনও রাজনৈতিক বার্তা না দিলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ব্রিগেডের জনসভা ছিল বকলমে ‘তৃণমূলের বিজয় উৎসব’।

Mamata in brigade in 2019

ব্রিগেডে মমতা

সাল ২০১৯ – সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ব্রিগেডে জনসভা। দেশের ২০টি দলের শীর্ষ নেতৃত্বদের নিয়ে এসে ব্রিগেডে বিজেপি বিরোধী জোটের মহড়া করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে নরেন্দ্র মোদী বিরোধী ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া র‍্যালি’-ই (United India Rally) ছিল সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় স্তরে ভারতের সব থেকে বড় বিরোধী ঐক্য মঞ্চ।

united india rally