মুখ্যমন্ত্রীর ‘দুয়ারের’ আদিগঙ্গা আছে সেই আদিতেই, মশার কামড়-কটূ গন্ধে অতিষ্ঠ তিলোত্তমাবাসী

Kolkata Municipality Election 2021: সেই অতি পরিচিত লাইন— কেন্দ্র- রাজ্য সংঘাত। আর সেই সঙ্ঘাতের জের পোয়াতে হচ্ছে তিলত্তমাবাসীকে। কথা হচ্ছে আদিগঙ্গার সংস্কার নিয়ে। যা নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে চলছে কেন্দ্র ও রাজ্যের দড়ি টানাটানি।

মুখ্যমন্ত্রীর 'দুয়ারের' আদিগঙ্গা আছে সেই আদিতেই, মশার কামড়-কটূ গন্ধে অতিষ্ঠ তিলোত্তমাবাসী
অলংকরণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 14, 2021 | 3:03 PM

সা য় ন্ত ভ ট্টা চা র্য

সেই অতি পরিচিত লাইন— কেন্দ্র- রাজ্য সঙ্ঘাত। আর সেই সঙ্ঘাতের জের পোয়াতে হচ্ছে তিলত্তমাবাসীকে। কথা হচ্ছে আদিগঙ্গার সংস্কার নিয়ে। যা নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে চলছে কেন্দ্র ও রাজ্যের দড়ি টানাটানি। এদিকে দুয়ারে এল আরও এক পুরভোট (Kolkata Municipality Election 2021)। এখনও সেই তিমিরেই আদিগঙ্গার সংস্কার! কাজ হবে কবে? কবে মুক্তি মিলবে মশার উপদ্রব আর কটূ গন্ধ থেকে? নির্বাচন আসে-যায়। নানা অজুহাতে বাকি থেকে যায় অনেক কাজ। এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপায়, চলে পারস্পরিক দোষারোপ। আর মাশুল গুনতে হয় সাধারণ মানুষকে। তেমনই এক বিষয় টালিনালা সংস্কার।

ভোটের হাওয়া এলেই টালিনালা বা আদিগঙ্গা সংস্কার নিয়ে ডান-বাম সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা স্থানীয়দের শুনিয়ে যান আশ্বাসের বাণী। অভিযোগ, অনুযোগ জানালে প্রতিশ্রুতি জোটে- এবার ক্ষমতায় এলেই হবে। ক্ষমতার বদল হয়। তার পর যে কে সেই অবস্থায় থেকে যায় আদিগঙ্গা। সংস্কার কোথায়? কলকাতার ৭৭ টি বড় নিকাশি নালার জল এসে মিশেছে এই আদিগঙ্গায়। যে কারণে সেই জল মিশকালো আবর্জনায় ভরে থাকে। এলাকায় মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ মানুষ। তিতিবিরক্ত এলাকাবাসী। দুয়ারে একুশের পুরভোট। এই সংস্কার নিয়ে কী বলছে পুরসভা?

যা জানাচ্ছে পুরসভা:

কলকাতা পুরসভা সূত্রে জানা যাচ্ছে, আগে ‘হ্যাম’ পদ্ধতিতে টেন্ডার করার কথা বলেছিল কেন্দ্র। কিন্তু তাতে কেউ অংশগ্রহণ করেনি। পরে কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র ফিরহাদ হাকিম ব্যক্তিগত ভাবে পুর ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রকের সচিব দুর্গাচরণ মিশ্রকে চিঠি দেন। তাতেই ‘বোট ‘ পদ্ধতিতে টেন্ডার করার অনুমতি মিলেছে। তবে টালিনালায় একটাই টেন্ডার পড়েছে। গোটা বিষয়টি বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছে গিয়েছে অনুমোদনের জন্য। পুরসভার আশা শীঘ্রই সেখান থেকে অনুমোদন চলে আসবে। আগামী জুলাই মাসে অনুমোদন চলে এলে অগস্ট – সেপ্টেম্বর নাগাদ ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এ নিয়ে শুক্রবার বৈঠকও হয়েছে। কলকাতা পুরসভায় মুখ্য প্রশাসকের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ব্রিজি, ওয়্যারলেস পার্ক এবং গলফ গার্ডেন – এই তিনটি জায়গায় নতুন সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হবে। নতুন একটি লিফটিং পাম্পিং স্টেশন তৈরি করা হবে ব্রিজিতে। টালিনালার দু’ধারে মান্ধাতার আমলের ১৬টি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট আছে। সেগুলি কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। সেই মেশিনগুলো সব বদল করা হবে।

গড়িয়া থেকে আলিপুর হয়ে দইঘাট পর্যন্ত ১৫.৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত এই টালিনালা। আশপাশের নিকাশির নোংরা জল আদিগঙ্গায় পড়ে যাতে তার দূষণবৃদ্ধি করতে করতে নাও পারে তাই এই সিদ্ধান্ত। এছাড়াও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আশপাশের এলাকার যত নিকাশি লাইন সরাসরি আদিগঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে, সেগুলির মুখ আদিগঙ্গা থেকে ঘুরিয়ে সরাসরি নিকাশি পাম্প স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। মোট ১১৪ কিলোমিটার এই নিকাশি লাইন মূল নিকাশি পাম্প স্টেশনগুলির সঙ্গে যুক্ত করা হবে। আর এই গোটা কাজে খরচ হবে ৪০৭ কোটি টাকা। বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে অনুমোদন পেলেই এই কাজ শুরু হবে বলে পুরসভা সূত্রে খবর। শেষ বৈঠকে এই কাজ সম্পূর্ণ করতে আড়াই বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

Adi Ganga

কলকাতার এক সময়ের লাইফলাইন কেমন ছিল আর আজই বা কেমন?

ফিরহাদের নির্দেশ, দেড় বছরের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে। পুর কমিশনারকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, দেড় বছরের মধ্যে অন্তত সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট এবং লিফটিং পাম্পিং স্টেশনগুলি তৈরি করতে হবে। গঙ্গার জলে জোয়ার এলে দেখা যায়, সেই জল খুব একটা আদিগঙ্গা ভিতরে ঢোকে না। বিভিন্ন অংশে যেভাবে পাইলিংয়ের কাজ হয়েছে সেই কারণে গঙ্গার জল আদিগঙ্গা ভেতরে জোয়ারের সময় ঢোকে না। তাই যে সংস্থা এই আদিগঙ্গা সংস্কারের কাজ করবে তাদের নির্দেশ দেওয়া হবে এই জোয়ারের জল যাতে আদিগঙ্গা ঢুকতে পারে তেমন ব্যবস্থা নেওয়ার।

তবে পরিবেশবিদদের কথায়, আগেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারপর তা ফাইলবন্দি হয়ে ঠান্ডা করে স্থান পেয়েছে। আদৌ এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাঁদের মধ্যে।

আদিগঙ্গা আদিতেই:

দেশের ৩৫১টি সব থেকে দূষিত নদীর শাখার মধ্যে আদিগঙ্গা অন্যতম। সেই আদিগঙ্গার সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনের চেষ্টায় কোনও খামতি থাকলে চলবে না। রাজ্য পরিবেশ দফতর, সেচ দফতর, কলকাতা পুরসভা ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে গত বছর অক্টোবর মাসে এই দায়িত্ব নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রায় দেয় ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল বা জাতীয় পরিবেশ আদালত। নির্দেশে বলা হয়, এই কাজের জন্য আদিগঙ্গার দু’পারে যত বেআইনি দখলদার রয়েছে, তাদের সরানো প্রয়োজন। আগামী ছ’মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দর (কলকাতা বন্দর) কর্তৃপক্ষের জমি পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় কি না, তা আলোচনার মাধ্যমে রাজ্য সরকারকে ঠিক করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। গত কয়েকবছর অবশ্য কখনও বেআইনি দখলদার, কখনও নিকাশি পরিশোধন প্লান্টের জমি নিয়ে সমস্যা তো কখনও আদিগঙ্গার উপরে মেট্রো রেলের স্তম্ভের জন্য আবর্জনা সাফাইয়ে অসুবিধায় সেই কাজ হয়ে ওঠেনি।

Adi Ganga

যে গঙ্গায় নৌকা চলত, আজ আবর্জনার আঁতুড়ঘর

এ নিয়েও নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিবেশ আদালতের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও আদিগঙ্গা রয়ে গিয়েছে আদিগঙ্গাতেই! ২৯ পৃষ্ঠার রায়ে সেই সব বিষয়েরই উল্লেখ করেছিল আদালত। কলকাতা পুরসভাকে তিনটি নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট তৈরির কাজ দ্রুত করতে বলার পাশাপাশি স্তম্ভ ও ‘এলিভেটেড’ স্টেশন নির্মাণের কারণে আদিগঙ্গায় জমা বর্জ্য এবং তা পরিষ্কারে অসুবিধা হওয়ার কারণে প্রয়োজনে মেট্রো রেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই বিষয়টি নিয়ে পুরভোটের আবহে বৈঠকে হয়েছে। মুখ্য প্রশাসক মেট্রোরেলের আধিকারিকদের জানিয়েছেন, টালিনালার উপরে থাকা মেট্রো স্টেশন গুলিতে যে শৌচাগার রয়েছে, যেগুলিতে থাকা পাইপলাইন সোজাসুজি আদিগঙ্গা না এনে পুরসভার নিকাশি পাম্পিং স্টেশনের লাইনের সঙ্গে যুক্ত করা হবে।

আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, রাজ্য পরিবেশ দফতর, সেচ দফতর, কলকাতা পুরসভা, টালি নালা প্রকল্প, কলকাতা মেট্রো রেলওয়ে এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের শীর্ষ কর্তারা এর সদস্য হবেন। বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য ‘নোডাল’ সংস্থা হিসেবে কাজ করবে কলকাতা পুরসভা। আর রাজ্যের মুখ্যসচিব ওই কমিটির কাজের তদারকি করবেন। আদিগঙ্গাকে আবর্জনামুক্ত করার পাশাপাশি তাতে যে নিকাশি নালাগুলি পড়ছে, তাদের অভিমুখ পরিবর্তনের বিষয়টি দেখার জন্য পর্ষদকে কড়া নজরদারি করার কথা বলা হয়।

অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ: 

এদিকে আদিগঙ্গা সংস্কারের জন্য বরাদ্দ অর্থ নিয়েও সমস্যা রয়েছে। রাজ্যের তরফে অভিযোগ, ‘ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা’ (এনএমজিসি) কর্তৃপক্ষ সংস্কারের টাকা দিচ্ছেন না। পরিবর্তে তাঁরা দখলদার সরানো, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক ভাবে কাজ করা, নালার ধারে ‘ফেন্সিং’ করা-সহ নানা শর্ত বেঁধে দিচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনএমজিসি আবার জানায়, তাদের তরফে কোনও শর্তই দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র এলাকাভিত্তিক ও ভৌগোলিক যে সমস্ত সমস্যা রয়েছে, সেগুলির কীভাবে সমাধান হবে, তা রাজ্যের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। কারণ, প্রকল্পের সাফল্যের জন্য তা অপরিহার্য। সংশ্লিষ্ট রায়ে এই বিষয়টিরও উল্লেখ রয়েছে। আদিগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে এবং তা সংস্কারের জন্য বরাদ্দ অর্থ কী ভাবে দেওয়া যায়, তার সম্ভাব্য পথগুলি এনএমজিসি-কে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছিল। এলাকাবাসী অত নিয়মের গেরো বোঝে না, রাজ্য ও কেন্দ্রের দ্বন্দ্ব জানতে চায় না। এবার কি হবে সংস্কারের কাজ? এটাই তাঁদের প্রশ্ন।

দেখুন ভিডিয়ো-