কলকাতা: রাজ্যে কলকাতা-সহ চার পুরনিগমে পুরভোট হয়েছে। বিধাননগর, আসানসোল, চন্দননগর, শিলিগুড়ি। কোনও পুরনিগমই বিজেপির হাতে আসেনি। খাস কলকাতাতেও ঘাসফুলের জয়জয়কার। একুশের বিধানসভা নির্বাচনেও ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির। দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কেন এমন হার? সাংগঠনিক দূর্বলতা নাকি নেপথ্যে অন্য কোনও কারণ। পুরভোটে দ্বিতীয় তো দূর, শতাংশের নিরিখে ওয়ার্ডভিত্তিক ফলাফল অনুযায়ী, তৃতীয় বা চতু্র্থস্থানে নেমেছে বিজেপি। আর এই তথ্য উঠে এসেছে বিজেপির জেলা ও রাজ্যে সাংগঠনিক পরিসংখ্যানমূলক গবেষণায়। এতেই কার্যত আশঙ্কার মেঘ দেখছেন দলের অন্দরেই।
ঠিক কী উঠে এসেছে ওই পরিসংখ্যানে?
চার পুরনিগমের ২২৬টি ওয়ার্ডের অর্ধেকেরও বেশিতে, অর্থাৎ ১২১টিতে বিজেপি নেমেছে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে। চন্দননগর পুরনিগমের ভোটে বিজেপি মাত্র একটি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় হয়েছে। ২৯টি ওয়ার্ডে তৃতীয়। দু’টিতে চতুর্থ। একটাতেও জয় আসেনি।
বিধাননগরের পুরনিগমের ভোটে একটি ওয়ার্ডেও পদ্ম- প্রার্থী জেতেননি। দ্বিতীয় ন’টি ওয়ার্ডে। তিন নম্বরে দলের ২৭ জন প্রার্থী। দু’টি ওয়ার্ডে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বিজেপি।
শিলিগুড়ি পুরনিগমের ভোটে ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে পাঁচটি বিজেপির দখলে এলেও ১৯টি ওয়ার্ডে তারা তৃতীয় এবং দু’টি ওয়ার্ডে চতুর্থ স্থানে নেমেছে। ২১টি ওয়ার্ডে দ্বিতীয়।
অন্যদিকে, আসানসোল পুরনিগমের ভোটে ৩৮টি ওয়ার্ডে বিজেপি পেয়েছে তৃতীয় স্থান! দু’টিতে চতুর্থ। ৫১টি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি। জিতেন্দ্র তিওয়ারির মতো হেভিওয়েট প্রার্থী থেকেও কার্যত কোনও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি।
বিজেপির পর্যবেক্ষণ
সদ্য শেষ হওয়া চার পুরনিগমের নির্বাচনে মাথা গোঁজার জায়গা পায়নি বিজেপি। ছোট ছোট পকেটে একটা দুটো ওয়ার্ডে জিততে পারলেও তৃণমূলের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ের পথে কখনও মনে হয়নি, বিজেপি টক্কর দেওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। কলকাতা পুরনিগম নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেমন ভরাডুবি হয়েছিল বিজেপির, চার পুরনিগমের ভোটেও কার্যত সেই একই ধরনের ফলাফল। তাহলে কি বিজেপির অন্দরেও দুই গোষ্ঠীর ভাগাভাগি? কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, অন্তত তাই। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তার জেরেই পুরনিগম নির্বাচনের ফলাফল এরকম। যদিও বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।
দিলীপের কথায়, “কোনও সংগঠন বা দল একজন মানুষের দ্বারা চলেও না। একজন মানুষের দ্বারা খারাপও হয় না।” তিনি আরও বলেন, “যে ধরনের অত্যাচার হয়েছে, তাতে বহু দলীয় কর্মী বাইরে বেরোচ্ছেন না। নির্বাচনে তাঁরা কাজও করেননি। যাঁরা গত বছর থেকে প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন, তাঁরা টিকিট নিতে আসেননি। যাঁরা টিকিট নিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে লোকে বেরোচ্ছে না, বেরোলে আবার পুলিশ ধমক দিচ্ছে। অনেকে বাড়ি ছাড়া আছেন। ফলে যে ধরনের শক্তি লাগিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত ছিল, তা আমরা করতে পারিনি।”
বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ
তাহলে গলদ কোথায়? বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনমুখী বঙ্গে আচমকা দলের সাংগঠনিক রদবদল মানতে পারেননি অনেকেই। বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর যেখানে উচিত ছিল, কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি করা, তাদের পাশে থাকা, সংগঠনের তৃণমূলীয় স্তরে নজর দেওয়া সেখানে কেবল দলের অন্দরের ক্ষোভই সামনে এসেছে। এখানেই শেষ নয়, যেভাবে দলের উচ্চপদস্থ নেতা-বিধায়করা, সাংসদেরা একে একে হোয়াটস্যাপ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন তার সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়েছে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে। ফলে, নেতৃত্বের উপরে আস্থা হারাতে শুরু করেছেন দলের কর্মীরাই। এছাড়া দলে আদি-নব্য কোন্দল তো রয়েছেই।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে আবার, বিজেপি হল লোকসভা ভিত্তিক দল। বিধানসভা নির্বাচন বা পুরনির্বাচনে লোকসভা জয়ের সেই স্ট্র্য়াটেজি কাজে আসেনি বলেই মনে করছেন অনেকে। ফলে লোকসভা কেন্দ্রিক যে বিপুল ভোট শতাংশ বিজেপির ঘরে এসেছিল, বিধানসভা নির্বাচনে ও পরে পুরনিগমের নির্বাচনে তা হ্রাস পেয়েছে। সেইদিক থেকে ক্রমেই শক্তি বাড়িয়েছে তৃণমূল। সাধারণ মানুষের জন্য নানা পরিষেবা চালু আসলে ঘাসফুলের ভোটব্যাঙ্ক বৃদ্ধি করার ইউএসপি। যা কার্যত বিজেপি করতে পারেনি বলেই দাবি করছেন অনেকে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ বোধহয়, শিলিগুড়ি পুরনিগমে নিজের ওয়ার্ডেই হেরে গিয়েছেন খোদ বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। এখন বাকি ১০৮ টি পুরসভার নির্বাচন বাকি রয়েছে। তাতে বিজেপি ঘুরে দাঁড়াতে পারে কি না সেদিকেই তাকিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল।