এই সমাজ এক ধাপ এগিয়েছিল যে দিন দ্য ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস (প্রোটেকশন অফ রাইটস) বিল, ২০১৯ পাশ হয়েছিল। পুনরায় এই বিল সংশোধিত হয় ২০২০-তে। সেখানে পরিচয়-শংসাপত্রের জন্য আবেদন, পরিচয়-শংসাপত্র প্রদান, সংশোধিত পরিচয়-শংসাপত্রের জন্য আবেদন ইত্যাদি বিষয়গুলো আরও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। ২৫ নভেম্বর, ২০২০ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় একটি অনলাইন পোর্টাল খোলা হবে, যেখানে রূপান্তরকামীরা (Transgender) তাঁদের পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করতে পারবেন। ২০২১ সালে সেই অনলাইন পোর্টাল খোলাও হয়। এখন ২০২২। আর আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস (International Woman’s Day 2022). অনলাইন পোর্টাল খোলার পর থেকে প্রায় এক বছরের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। কতজন রূপান্তরকামী মানুষ এই সুবিধা পেয়েছেন? কীভাবে এই সুবিধা পেতে হয়? এই সব প্রশ্নের উত্তর আজও অনেকেরই অজানা। সম্প্রতি অনুপ্রভা দাস মজুমদার তাঁর ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেট (Transgender Certificate) পেয়েছেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন TV9 বাংলার সঙ্গে। অনুপ্রভা, একজন রূপান্তরকামী মহিলা। অনুপ্রভা ‘প্রান্তকথা’ নামক একটি মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বিভিন্ন প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষ এবং যুব সমাজের মানুষের সঙ্গে কাজ করেন।
অনুপ্রভা যা বললেন,
“তখন ২০২০ সাল। আমি কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছিলাম। এয়ারপোর্টে আমি নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে পরিচয় দিই এবং অনুরোধ জানাই, এভাবে আমাকে পুরুষ বিভাগের লাইনে দাঁড় করিয়ে ওপেনলি সার্চ করবেন না। কিন্তু তখন আমার ভোটার কার্ড, আধার কার্ডে আমার বায়োলজিক্যাল পরিচয় লেখা। তখন ওনারা জানতে চান যে আমার কাছে রূপান্তরকামী হওয়ার কোনও প্রমাণ আছে কি না। সে দিন এয়ারপোর্টে আমার অনুরোধ রাখা হয়নি। কিন্তু আজ আমার কাছে রূপান্তরকামী হওয়ার প্রমাণ রয়েছে।
ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেট হাতে পেতে সময় লেগেছে চার মাস। কিন্তু এই সার্টিফিকেট পাওয়ার লড়াইটা শুরু হয় অনেক আগে থেকে। প্রথম যখন ২০২০ সালে ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়া উল্লেখ করা হয়, তাতে অনেকগুলো বিষয় বলা হয়েছিল। যেমন জেলাশাসকের দফতরে আবেদন করতে হবে এবং সেখান থেকে সরাসরি এই সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। এর সঙ্গে একটি বোর্ড থাকবে সেখানে সাইকোজলিস্টরা থাকবেন এবং আবেদনকারীকে একটা স্ক্রিনিং পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তারপর তিনি সার্টিফিকেট পাবেন। লিঙ্গ নির্ধারণের অধিকার যেহেতু তাঁর, তাই এই স্ক্রিনিং পদ্ধতির বিরুদ্ধে জোরদার আওয়াজ তোলা হয় এবং দাবি জানানো হয় এই প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করার জন্য।
আবারও পরিবর্তন করা হল ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেট আবেদন করার প্রক্রিয়া। সেই সময় বলা হয় যে, ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেটের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হবে এবং এটার জন্য কোনও স্ক্রিনিং কমিটি থাকবে না। এরপর পোর্টাল খোলা হল। কিন্তু তখনও অনলাইনে আবেদন করার প্রক্রিয়া স্পষ্ট নয়। এই সার্টিফিকেট কীভাবে পাওয়া যাবে, কী ধরনের হলফনামা প্রয়োজন, আরও কী-কী নথি প্রয়োজন… এই ধরনের প্রশ্নগুলো থেকেই গিয়েছিল। তখন জানা যায়, এই সার্টিফিকেটটি ওই ব্যক্তির বিভিন্ন পরিচয় পত্র যেমন ভোটার কার্ড, আধার কার্ড এগুলো পেতে সাহায্য করবে।
২০২০ সালের আগেও বহু মানুষ তাঁদের পরিচয়েপত্রে লিঙ্গ, নাম ইত্যাদি পরিবর্তন করিয়েছেন। কিন্তু অন্য পদ্ধতিতে করিয়েছেন। সাধারণভাবে হলফনামা করে, বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অনেকেই নিজের পরিচয়পত্র পরিবর্তন করিয়েছেন। এরপর ওই পোর্টাল আসে। কিন্তু পোর্টালে কিংবা অফলাইন মাধ্যমে রূপান্তরকামী মহিলা বা পুরুষ আলাদা করে নির্বাচন করা যায় না। শুধুই ‘ট্রান্সজেন্ডার’ অপশন রয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে গেলে প্রাথমিক কিছু নথি জমা করতে হয়। প্রথমত, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করতে হবে। কেউ যদি সার্জারি না করান, তাহলে তিনি এই সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে পারবেন না।
আমি ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেটের জন্য প্রথম আবেদন করি ২০২১ সালের অগস্টে। সেই সময় দু’বার আমার আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়। ওনারা জানান যে আমার ছবি এবং কিছু শারীরিক চিহ্ন স্পষ্ট নয়। তখন যেহেতু কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা ছিল না, তাই-ই অনেক বিভ্রান্তি ছিল। যেমন ওনারা যে সই চাইছেন সেটা আমি কোন নামে করব, আমার নতুন নামে নাকি আমার পুরনো নামে। এই বিষয়গুলো পরবর্তীকালে পোর্টালে উল্লেখ করা হয়। অনেক কিছু সংশোধিত হয়। বিষয়গুলি মধ্যে অনেক স্বচ্ছতা আনা হয়।
২০২১ সালের নভেম্বরে আবার আমি ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করি এবং দু’বার আবেদন বাতিলের পর অবশেষে এটি গ্রহণ করা হয়। আইন অনুযায়ী, আবেদন গ্রহণের এক মাসের মধ্যে এই সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার কথা। যথারীতি আমি এক মাস অপেক্ষা করি এবং কোনও সার্টিফিকেট বা বিজ্ঞপ্তি পাই না। এরপর আমি পোর্টালে দেওয়া হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করি এবং সেখানে আমায় জানানো হয় যে পোর্টালের তরফ থেকে জেলাশাসকের দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর প্রায় দু’ মাস কেটে যায়। পোর্টালের তরফ থেকে জানানো হয় যে, অনেক চিঠি দেওয়া হলেও জেলাশাসকের অফিস তরফ থেকে তেমন কোনও উত্তর আসছে না। তখন আমায় বলা হয় একবার জেলাশাসকের অফিসে যোগাযোগ করতে।
তারপর আমি জেলাশাসকের বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করি। একটা অফিসে ফোন করলে বলা হয় অন্য আরেকটা অফিসে খোঁজ নিতে। কোন দফতরে এই বিষয়টি দেখছে, তাঁরা বলতে পারেন না। কোথাও থেকে কোনও রকম তথ্য না পাওয়ায় আমি উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে আরটিআই (রাইট টু উনফরমেশন বা তথ্য জানার অধিকার)-এ আবেদন করি। ‘প্রান্তকথা’ সংগঠনের পক্ষ থেকে দু’টি প্রশ্ন রেখে আরটিআই করা হয়। এক, ২০২০ থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁরা ক’টা ট্রান্স কার্ড ইস্যু করেছেন এবং দ্বিতীয়, জেলাশাসকের কোন দফতর এই বিষয়টি দেখছে।
এক মাসের মধ্যে আরটিআই-এর উত্তর আসে যে, এখনও অবধি সরকারের পক্ষ থেকে জেলাশাসকের অফিসে এই সার্টিফিকেট সম্পর্কিত কোনও বিজ্ঞপ্তি আসেনি। ইতিমধ্যে উত্তর না পেয়ে আমরা ‘প্রান্তকথা’-র হয়ে ঠিক করি যে আমরা কোর্টে যাব। এর মধ্যে আমরা কাকলি ঘোষ দস্তিদার (বারাসাতের সাংসদ) সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং অনুরোধ জানাই আমাদের একটু সাহায্য করার জন্য। এই সব কিছুর মাঝেই কয়েক সপ্তাহ আগে আমার কাছে জেলাশাসকের অফিস থেকে একটা ফোন আসে। সেখানে জানানো হয় যে, তাঁরা আমার আবেদনটা পেয়েছেন এবং একটি বিষয় সেখানে উল্লেখ নেই। এরপর সেটি আমায় মেইল করে জানানো হয় এবং বলা হয় সেই বিষয় উল্লেখ করে পুনরায় আবেদন করার জন্য। তখন আমি জানতে পারি যে, ওনাদের কাছে এই সার্টিফিকেট অনুমোদন করার কোনও উপায় ছিল না। তখন বুঝলাম যে একটা সিস্টেম শুরু করতে গেলে একটা ন্যূনতম সময় লাগে।
অবশেষে ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ হাতে পেলাম বহু প্রতীক্ষিত ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেট। জেলাশাসকের অফিস থেকে একটা ফোন আসার এক সপ্তাহ পরেই ওই পোর্টাল থেকেই ডাউনলোড করলাম আমার সার্টিফিকেট। এটা আমার কাছে একটা বিশাল বড় প্রাপ্তি। এখন আমার হাতে একটা সরকারি প্রমাণপত্র আছে। এখন কথা বলার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। এর আগে তো আমার মুখের কথা ছাড়া কোনও প্রমাণ ছিল না। এবং ভারতবর্ষের একজন নাগরিক হিসাবে এই প্রমাণপত্র আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে। দেরি হলেও আমি আমার পরিচয়পত্র হাতে পেয়েছি এবং পরবর্তী পদক্ষেপগুলো আমি করতে পারব। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড ইত্যাদির জন্য আবেদন করতে পারব। পুরনো সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক সব জায়গায় এই পরিচয়পত্র জমা দিতে পারব। ভীষণ ভাল লাগছে।”
অনুলিখন- মেঘা মন্ডল
গ্র্যাফিক্স: অভীক দেবনাথ
আরও পড়ুন: ফিমেল অর্গ্যাজ়ম: শরীর যখন মনের কথা বলে
আরও পড়ুন: ‘গ্রুপিজ়ম’-এ নারীরা, শিখছে আর শেখাচ্ছে সাবলম্বী হওয়ার পাঠ