International Woman’s Day 2022: ফিমেল অর্গ্যাজ়ম: শরীর যখন মনের কথা বলে
Woman's Day-Men's Role Play: ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও পুরুষ কি মহিলাদের চাহিদা সম্পর্কে সংবেদনশীল? খোঁজ করল TV9 বাংলা।
স্নেহা সেনগুপ্ত
রাতের নিস্তব্ধতায় কী যেন খোঁজে ভ্রমর। অবিন্যস্ত চুলে আঙুল বোলাতে থাকে, আর ভাবতে থাকে সেই পুরুষটির কথা, যাকে সে মনে-মনে ভেবেছিল তার দোসর। এমন এক দোসর যার কাছে আড়াল নেই, আবডাল নেই… নেই ভয়। এমনকী কুণ্ঠাও। ঋতমকে অনেকবারই বলেছে কথাগুলো। কিন্তু সে বোঝেনি। ক’জন পুরুষই বা বুঝতে পারে। নিশুতি রাতের আঁধারে ভ্রমর খোঁজে তার না-চাওয়াকে। যে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে আজ পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি নারী। তার দুর্দমনীয় ‘প্রেম’ উজাড় করে দিয়েছে পুরুষ। জর্জ বার্নার্ড শ’ তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, “আমি তোমাকে ভালবাসি না। আমি তোমাকে উপলক্ষ্য করে নিজেকেই ভালবাসি।” এক্ষেত্রে পুরুষও কি তাই? সে-ও কি নিজেকে উপলক্ষ্য করে নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়? কেবলমাত্র নিজেকে ভাল রাখার জন্যই অন্তরঙ্গ হয়? নিজে তৃপ্ত থাকার জন্য! নারীকে তৃপ্ত করা কি তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?
ভাবতে থাকে ভ্রমর। ভাবতে থাকে ‘অর্গ্যাজ়ম’-এর কথা। শব্দটা তার কাছে মিথের চেয়ে কম কিছু নয়। ভ্রমর সেই স্পর্শের অনুভূতি আজও পায়নি। কিন্তু সে বিলক্ষণ জানে, মহিলাদেরও ‘চরম সুখ’ বলে কিছু একটা হয়। বইয়ে পড়েছে। বন্ধুদের আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে অর্গ্যাজ়মের প্রসঙ্গ। বন্ধুদের মুখে তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছে। কিন্তু নিজে অনুভব করেনি। বন্ধুরা তাকে বুঝিয়েছে কীভাবে কী হয়। কিন্তু মৌখিক বর্ণনা এবং বাস্তবে ‘ঘটে যাওয়া’র মধ্যে আসমান-জমিনের তফাৎ।
ইদানিং বেশ খিটখিটে হয়ে গিয়েছে ভ্রমর। বয়স ৩০ পেরিয়েছে তার। ঋতমের উপর অভিমানের অঙ্ক ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেও মন দিতে পারে না। ঋতমকে বিছানাতেও পছন্দ হচ্ছে না তার। তীব্র অতৃপ্তি তাড়া করছে মেয়েটাকে। ‘আউট অফ লাভ’ হল নাকি? ভ্রমরে কলেজের বন্ধু মোহক ওকে বলেছিল ‘তোর হয়?’ মোহকের মুখে এই প্রশ্ন শুনে তার প্রতি কলেজ জীবনের ভাল লাগা ক্ষণিকের জন্য মনে পড়েছিল ভ্রমরের। কই, ঋতম তো তার কাছে জানতে চায় না! এখন কী করবে ভ্রমর?
ভ্রমরদের সংখ্যা কম নয়। ঋতমরাও সংখ্যায় অনেক। মাঝেমধ্যে একজন, দু’জন মোহক জিজ্ঞেস করে ফেলে। মহিলাদের চরম তৃপ্তির জায়গাটা ঠিক কোথায়? মস্তিষ্কে না শরীরে। নাকি দু’টোই একে-অপরের সঙ্গে সমান্তরাল? একটাকে ছাড়া অন্যটা অপূর্ণ। ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও পুরুষ কি মহিলাদের চাহিদা সম্পর্কে সংবেদনশীল?
‘বিষ’, ‘গান্ডু’, ‘তাসের দেশ’-এর অভিনেত্রী তথা বর্তমানে বাংলা ধারাবাহিকে অভিনয়-করা ঋতুপর্ণা সেন জনপ্রিয় ‘ঋ’ নামেই। মহিলাদের অর্গ্যাজ়ম সম্পর্কে TV9 বাংলার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলেছেন ঋ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন তিনি। বলেছেন, “ছেলেদের বোঝার আগে মেয়েরা বিষয়টা কতখানি বোঝে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। কেবল সেক্স এডুকেশনের ক্ষেত্রে নয়। শরীর দিয়ে বোঝার বিষয় আছে। আমার মনে হয় এর জন্য একজন গুরুকে প্রয়োজন। একজন পার্টনারের ভীষণ দরকার, যে বোঝাবে। আমাদের দেশ এখনও ততটা প্রগতিশীল হয়ে ওঠেনি যে মা বোঝাবে, পিসি বলবে… বা ওই বয়সের কেউ বলবে। আমার মনে হয় ছেলে কিংবা মেয়ে উভয়ের জীবনে একজন গুরু আসতে পারেন, যিনি এই অনুভূতির কথা বলবেন। ছেলের সঙ্গে মেয়েদেরও বোঝা দরকার কীভাবে অর্গ্যাজ়ম হয়। তারপর আসে সেই পুরুষ, যে সঠিক চাহিদা বুঝবে।”
অনেক সময়ই দেখা যায়, পুরুষের যৌনতৃপ্তি লাভ হওয়ার পর সে নির্বিকার হয়ে রয়েছে। সে তৃপ্ত, তার আর জানারই প্রয়োজন নেই অপর দিকের মহিলা কী চাইছেন। ঋ বলছেন, “আমি বলব বাঙালি পুরুষরা কিন্তু খুব একটা জিজ্ঞেস করে না। জানতে চায় না নারীর তৃপ্তির কথা। আমি পুরুষবিদ্বেষী নারী নই। সম্প্রতি নারী দিবস নিয়ে এক মহিলার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি নারী দিবস নিয়ে কথা বলছিলেন। আমি বলেছিলাম মহিলা এবং পুরুষের আলাদা-আলাদা করে কোনও দিন হয় না। আমি দু’জনকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।”
নিজের জীবনের ঘটনার কথা শেয়ার করতে-করতে ঋ বলেন, “আমি কিন্তু খুব লাকি সেই অর্থে। আমি নিজে এমন কিছু পার্টনারদের পেয়েছি, যাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার অর্গ্যাজ়ম হয়েছে কি না। আমি তৃপ্ত হয়েছি কি না। কিন্তু অনেকেই ছিলেন, যাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেননি। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করেননি। আমার মনে হয় একজন পুরুষের জিজ্ঞেস করার আগে নারী হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কেবল কর্মক্ষেত্রে নয়, সহবাসেও। নারীকে নিজেকে স্থির করতে হবে তিনি অর্গ্যাজ়ম চান কি না। এবার সেখানেই সমস্যা। মহিলারা তো বলেই উঠতে পারেন না। আসলে এটা একটা প্রক্রিয়া। হয়তো সেই জায়গায় কোনও-কোনও মহিলা সত্যি পৌঁছতে পারেন। কোনও-কোনও মহিলা জীবনেও পৌঁছতে পারবেন না।”
চূড়ান্ত তৃপ্তির জন্য নিজেকে কীভাবে তৈরি করতে পারেন কেউ, বলেছেন ঋ। তাঁর বক্তব্য খুবই স্পষ্ট, “সেল্ফ মাস্টারবেশন বলেও একটা বিষয় আছে। সেটা একটা পন্থা। নারীতে-নারীতে সেই চাহিদা আলাদা হতে পারে। আমি একটা প্যাথোলজিক্যাল কথাই বলছি – অনেক নারীর যৌন তৃপ্তি হয় মাস্টারবেশনের সাহায্যে। কিন্তু পার্টনারের সঙ্গে সেক্স করে হয় না। অনেকে আছেন সেক্স করেই তৃপ্ত হতে পারেন, মাস্টারবেশনে হন না। এটা নিয়ে আমার একটা ডকুমেন্টারি করার ইচ্ছে আছে। বিষয়টায় কিন্তু আমি পুরুষকেও দোষ দিই না। অনেক মহিলাও ফেক অর্গ্যাজ়ম করেন। পুরুষরা নাকি অর্গ্যাজ়মে টার্নড-অন হন। কিন্তু তাঁরা জানেন না কীভাবে কোনও মহিলাকে তৃপ্ত করতে হবে। মহিলা নিজেও জানেন না কীভাবে সেই মার্গে পৌঁছতে হয়।”
ঋয়ের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি যোগাযোগ করা হয়েছিল মনোবিদদের সঙ্গেও। মনোবিদ বিদিতা ভট্টাচার্য বলেছেন, “পুরুষরা কিন্তু বোঝেন। একটি শারীরিক সম্পর্ক যখন তৈরি হয়, পুরুষরা সবটাই টের পান। কিন্তু সেই বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটাই আসল বিষয়। গোটা বিষয়টাই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। আমাদের চারপাশে সংবেদনশীল মানুষ আছেন, অসংবেদনশীল মানুষও আছেন। অসংবেদনশীলতার রিপোর্টিংটাই বেশি হয়। মনে হতে শুরু করে সকলেই অসংবেদনশীল। তবে একটা কথা আমি বলতে চাই, আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেকটাই পালটেছে। অনেক পুরুষই এখন স্ত্রীর সমস্যা থাকলে সেটা আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। তবে সংবেদনশীলতা বিষয়টা জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রেই রিফ্লেক্টেড হয়। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসংবেদনশীল।”
আমাদের দেশের মহিলারা কি বোঝেন অর্গ্যাজ়ম বিষয়টা ঠিক কী? বিদিতার উত্তর, “বোঝেন। কিন্তু অর্গ্যাজ়ম শব্দটার সঙ্গে হয়তো তিনি পরিচিত নন। এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম বিষয়। দৈনন্দিন জীবনের একটা ছাপ থাকে, সম্পর্কটা আসলে কীরকম সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অরগ্যাজ়ম বিষয়টা কে কীরকমভাবে গ্রহণ করছেন, সেটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। যাঁদের কোনও ট্রমা বা অ্যাবিউজ়ের হিস্ট্রি আছে, তাঁরা কিন্তু অর্গ্যাজ়ম বিষয়টাই পছন্দ করেন না। অর্গ্যাজ়ম না-হওয়াতেই তাঁরা খুশি থাকেন। শারীরিক মিলনেও তাঁদের সমস্যা হতে দেখা যায়। সেটা মানসিক ব্লকেজ তো বটেই। ড্রাইনেস কিংবা বার্নিং সেনসেশন, লুব্রিকেশন না-হওয়া এগুলো হতে থাকে। পার্টনারের কোনও কথায় মনে আঘাত লাগলেও মহিলাদের শারীরিক মিলনে তীব্র অনীহা তৈরি হতে পারে। তিনি কিন্তু তখন অন্য কারও প্রতিও আকর্ষিত হতে পারেন।”
মনোবিদ শতভিষা চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলছেন, “আমরা যদি কিছুক্ষণের জন্য নারী-পুরুষের এই সংজ্ঞাগুলোকে সরিয়ে রেখে ভাবতে শুরু করি আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে কোথাও গিয়ে যৌনতা নিয়ে আলোচনা করার প্রবণতা আজকাল উঠে গিয়েছে। ‘আজকাল’ এবং ‘উঠে গিয়েছে’ এই দু’টো প্রসঙ্গই ঐতিহাসিক দিক থেকে এতখানি খারাপ অবস্থায় ছিল না। যে কারণে যৌনতার ধারণা পর্নোগ্রাফি কিংবা বন্ধুদের মুখে শোনা কথা, প্রচলিত ধ্যানধারণা কিংবা মিথ—এগুলোর উপর ভিত্তি করে। একজন মহিলা নিজের শারীরিক চাহিদার কথা কীভাবে জানাবেন, তাঁর কোনটা পছন্দ হল, কোনটা হল না… এটা জানানোতে কুণ্ঠা চলে এসেছে। যৌনতার মধ্যে অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে ফোর-প্লে। নিজেদের কীভাবে এক্সপ্রেস করবেন, সেখানেও বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষদের যৌনসুখ পিনাস অংশ জুড়ে থাকে। তেমনই মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনি কিংবা ভ্যাজাইনাকেন্দ্রিক হতে হবে তেমন কিন্তু নয়। তাঁদের কাছে শরীরের এরোটিক জ়োনস বা শারীরিক সন্তুষ্টি পাওয়ার জায়গা ভিন্ন হতেই পারে। সেই পথেও কোনও নারী চডরম সুখ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন। ‘কামসূত্র’-এ অনেকভাবেই বিষয়গুলি বর্ণনা করা হয়। বাৎসায়নের পথেও তো হাঁটা যেতে পারে।”
গ্র্যাফিক্স: অভীক দেবনাথ
আরও পড়ুন: International Woman’s Day 2022: মা ‘হয়ে-ওঠা’ সেইসব বাবারা কতটা সামলে উঠলেন সংসারের ভার?
আরও পড়ুন: Women’s Day 2022: ‘গ্রুপিজ়ম’-এ নারীরা, শিখছে আর শেখাচ্ছে সাবলম্বী হওয়ার পাঠ
আরও পড়ুন:Women’s Day 2022: আমি পেশাগতভাবে ডিজে… মিউজিক বাজাই, বেলেল্লাপনা করি না