International Woman’s Day 2022: মা ‘হয়ে-ওঠা’ সেইসব বাবারা কতটা সামলে উঠলেন সংসারের ভার?

Woman's Day 2022 - Men and Women: আজ নারী দিবসে আমরা সেই সব পুরুষদেরকেই সেলিব্রেট করব, যাঁরা আমাদের জীবনে কখনও 'মা', কখনও 'দিদি' কিংবা 'বান্ধবী' হয়ে ধরা দিয়েছেন। যাঁরা ভুলিয়েছেন লিঙ্গের ভেদাভেদ। মানুষ হিসেবে তৈরি করেছেন নতুন পরিচয়। সাম্যকেই করেছেন আশ্রয়।

International Woman's Day 2022: মা 'হয়ে-ওঠা' সেইসব বাবারা কতটা সামলে উঠলেন সংসারের ভার?
নারী দিবসের বিশেষ প্রতিবেদন - বাবাদের মা 'হয়ে ওঠা'।
Follow Us:
| Updated on: Mar 08, 2022 | 10:42 AM

স্নেহা সেনগুপ্ত

একবার এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক মেঘনা গুলজ়ার (Meghna Gulzar) তাঁর বাবা কিংবদন্তি গুলজ়ার (Gulzar) সম্পর্কে বলেছিলেন, বাবা নাকি তাঁর জন্য আজীবন সেই সমস্ত কর্তব্য পালন করেছেন, যা মায়েরা করে থাকেন। মেঘনার চুলের বিনুনি বাঁধা থেকে তাঁর জন্য পছন্দসই খাবার তৈরি করা, তাঁকে সাজিয়ে-গুছিয়ে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া… সুরের মালায় কথা সাজানোর পাশাপাশি, ছবি পরিচালনার পাশাপাশি, কবিতা লেখা, চিত্রনাট্য লেখা কিংবা গল্প লেখার পাশাপাশি তিনি মেঘনার ‘মা’ হয়ে উঠেছিলেন।

যেমন ধরুন আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টের পৃথ্বীশদা। স্ত্রী আনন্দিদি কাজের সূত্রে আজ অস্ট্রেলিয়া, কাল লন্ডন। লকডাউন থেকে পৃথ্বীশদার ওয়ার্ক ফ্রম হোম। আগেও দেখেছি বাড়িতে থেকেই তিনি অফিসের কাজ করছেন। এ দিকে, আনন্দিদি পাখির মতো। খোলা আকাশে ওঁর উড়াণ। ছোট্ট ছেলে (টিনটিন) আছে ওঁদের। আমাদের বসার ঘরের জানালা দিয়ে ওঁদের রান্নাঘর দেখা যায়। আমাদের বাড়িতেও গীতাদি কাজ করতে আসেন, ওঁদেরও। তাই আমার শাশুড়িমায়ের সঙ্গে গীতাদির ফাঁকিবাজি সম্পর্কে নালিশ করেন পৃথ্বীশদা-ই। রান্নাঘরের স্ল্যাবে টিনটিনকে দেখি এটা-ওটা ফরমাইশ করছে বাবাকে। বাবাও দিব্যি অ্যাপ্রন পরে, হাতে খুন্তি নিয়ে ছেলেকে পড়া ধরছেন। টিনটিনকে একদিন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি মাকে মিস করো না?” টিনটিন ভ্যাবলা চোখে তাকিয়ে অনেকক্ষণ পরে বলেছিল, “করি। কিন্তু সব সময় না।”

…ছোট্ট ছেলেটার ওইটুকু কথায় হয়তো লুকিয়ে ছিল বিবর্তিত সমাজের এককুচি চিত্র। মাকে যে আলাদা করে মিস করতে হয়, সেই চিরাচিত নিয়মটাই হয়তো সে জানে উঠতে পারেনি এখনও। হয়তো বাবা-মায়ের সাংসারিক সমীকরণে সে এমন কোনও আঁচ সত্যিই পায়নি, যা তাঁকে মায়ের অভাব টের পাইয়ে দেবে।

টিনটিন বলেছে মাকে সে মিস করে, কিন্তু সব সময় না। কৌতূহলী আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম: কখন-কখন সে মাকে মিস করে? টিনটিন বলেছিল, “সেই সব দিনে, যখন বাবা দারুণ কোনও রান্না করে আর মা খেতে পারে না।” কিংবা সেই সব দিনে, যখন স্কুলের খাতায় ‘গুড’ পাওয়ার আনন্দ-মুহূর্ত সে মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। মায়ের কাছে তৎক্ষণাৎ বয়না করতে পারে না। ছোট্ট ছেলেটা কিন্তু একবারও বলল না, ‘মায়ের রান্না মিস করি’ কিংবা ‘মায়ের ঘুম পাড়ানো’… বলেছিল, ওটা তাঁকে বাবা-ই করে দেয়…। চোখের সামনে দু’টি অদৃশ্য শক্তিকে মিশে যেতে দেখেছি। মনে হয়েছে, পাল্টাচ্ছে… সব পাল্টাচ্ছে। প্রশ্ন জেগেছে মনে। মনে হয়েছে, ৮ই মার্চ: নারী দিবসের ‘বজ্র নির্ঘোষ’-এর আলাদা কোনও তাৎপর্য সত্যি আর আছে কি না। ‘সমান-সমান দিবস’ পালন করার সময় এসে গিয়েছে হয়তো।

সেই সুদিন আগত। তবুও আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে (International Woman’s Day 2022) আমরা সেই সব পুরুষদেরকেই সেলিব্রেট করব, যাঁরা আমাদের জীবনে কখনও ‘মা’, কখনও ‘দিদি’ কিংবা ‘বান্ধবী’ হয়ে ধরা দিয়েছেন। যাঁরা ভুলিয়েছেন লিঙ্গের ভেদাভেদ। মানুষ হিসেবে তৈরি করেছেন নতুন পরিচয়। সাম্যকেই করেছেন আশ্রয়।

নাট্যব্যক্তিত্ব ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী সোহিনী সেনগুপ্তর (Sohini Sengupta) বেড়ে ওঠা অনেকটা আমাদের টিনটিনের মতোই। এক সাম্যময় পরিবেশে বড় হয়েছেন সোহিনী। তাই হয়তো কথাগুলো আমাদের ওভাবে বলতে পেরেছেন।

সোহিনী সেনগুপ্ত যা বললেন: “আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমার মা (অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পী ও নাট্যব্যক্তিত্ব স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) তখন সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইর’-এর শুটিং করছিলেন। আমার বাবাকে (নাট্যব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) দেখতাম বাড়ির সমস্ত কাজ করতেন। রান্না করতেন নিয়মিত। বাড়িতে মায়ের যা-যা কাজ ছিল, সেগুলো বাবা করতেন মায়ের অনুপস্থিতিতে। ছোট থেকেই একটা জিনিস দেখেছি: স্ত্রী বা বাড়ির বউ বলে মায়ের উপর আলাদা কোনও শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হত না। তাঁকে কোনও প্রকার চাপ দেওয়া হত না। কখনওই বলা হত না রান্নাটা তাঁকে করতেই হবে। কিংবা নিয়মিত যে-যে কাজ মেয়ে হিসেবে করাই দস্তুর, সেগুলো তাঁকেই করতে হবে। মা স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে কাজগুলো করতেন। বাবা মা-কে কমান্ড করেননি কোনওদিন। কিংবা আশাও করেননি, মা-ই কাজগুলো করবেন। এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই জিনিসটা দেখেই আমি বেড়ে উঠেছি। মানুষ হিসেবে ‘সমান-সমান’ চিন্তাভাবনা করার রাস্তা অভিভাবকেরাই দেখিয়ে দিয়েছিলেন আমার মেয়েবেলায়। সুতরাং পরিবেশ একটা ফ্যাক্টর।”

নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবতী বলে মনে করেন সোহিনী। এক দিকে, যেমন বাবার বাড়িতে সাম্যময় পরিবেশে বড় হয়েছেন, অন্য দিকে স্বামীর কাছেও একই পরিবেশ পেয়েছেন। বলেছেন, “নিজেকে আমি ভাগ্যবতী বলে মনে করি। আমার স্বামীর (অভিনেতা সপ্তর্ষি মৌলিক) বাড়িতেও ঠিক একই রকম ছবি। সপ্তর্ষির বাবাও কোনওদিন জোর করে আমাকে দিয়ে রান্না করাননি কিংবা এসে বলেননি এটা খাব, সেটা খাব। আজ পর্যন্ত বলেননি। আমার শাশুড়ি মা কলাভবনের ছাত্রী। নিজে স্বাধীনভাবে বুটিক চালান। সেইখানেই উনি কাজ করেন। নিজের ক্ষমতা মতো অর্থ উপার্জন করেন। শ্বশুরমশাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্যও সুন্দরভাবে পালন করেন। বাবা অনেক সময় নিজেই সমস্ত কাজ করে নেন। এই পরিবেশে আমার স্বামীও বেড়ে উঠেছেন। সুতরাং, ও-ও কিন্তু ওর বাবার মতোই। যে দিন আমি শুটিং থেকে দেরিতে বাড়িতে ফিরি, সপ্তর্ষি আমাকে খাবার গরম করে প্লেটে সাজিয়ে দেয়। আমাদের সংসারে আমার ও আমার স্বামীর রোল প্লে সমান-সমান। সংসারের খরচও আমরা সমান-সমান ভাগ করে নিই। এগজ্যাক্ট হাফ-হাফ! মাসের শুরুতে সমপরিমাণ অর্থ আমরা একত্র করি। এবং সপ্তর্ষি এটাই ইনসিস্ট করে।”

সোহিনী কিংবা সপ্তর্ষি আমাদের সকলকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। সোহিনীর কথাতেই তা স্পষ্ট রূপ পেল। অভিনেত্রী বলেছেন, “এরকম হয়েছে, আমি কম রোজগার করেছি, তাও সমান-সামন অর্থ ভাগাভাগি করেছি। আবার অনেক সময় সপ্তর্ষি কম রোজগার করেছে, তখনও ও সমান অর্থ দিয়েছে। এটা আমাদের মধ্যে অলিখিতভাবে চলছে। এবং আমরা দু’জনেই এতে বেজায় খুশি। কেবল অর্থ নয়। বাড়ির কাজের ক্ষেত্রেও আমরা সমান-সমান অংশীদার।”

নারীর সুবিধের জন্য ব্যবহৃত অস্ত্র ‘নারীবাদ’কেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি সোহিনী। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যখনই অর্থনৈতিক ভাগাভাগির বিষয়টা আসে, তখন প্রায়শই নারীবাদী সত্ত্বা উড়ে যায়। মহিলারা পিছপা হয়ে যান। এ ব্যাপারে আপনার কী মতামত?

সহমর্মিতার সঙ্গে সোহিনা বলেছিলেন, “এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে নারীবাদকে অনেকেই গুলিয়ে দিয়েছেন। এটা তো আসলে সমান পরিশ্রম পাওয়ার বিষয়। নারী-পুরুষের সমান অর্থিক উপার্জন। ইকুয়্যাল পে-এর জায়গাটা এখনও আসেনি যদিও। যে কোনও সার্ভিসের জন্য এখনও পর্যন্ত একটাকা হলেও কম পান মহিলারা। মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনই মেয়েরাও দেখেছি নিজেদের দিকে ঝোল টেনে অনেক কথা বলেন। ছেলেদেরও কিন্তু ছোট থেকেই শিখিয়ে দেওয়া হয় তোমাকে বড় হয়ে চাকরি করে কিছু দায়িত্ব পালন করতেই হবে। একজন মেয়ে যদি অর্থ উপার্জন না-ও করেন, সমাজ কিন্তু তাঁকে বকাবকি করে না। সমাজ জানে যে সে বিয়ে করবে। এটা কিন্তু একজন ছেলের প্রতিও অন্যায়। এখন উভয় পক্ষেরই দায়ভার ভাগ করে নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। মহিলাদেরও এগিয়ে এসে অংশ নিতে হবে। আমি দেখেছি, অনেকক্ষেত্রে মেয়েরাই অংশীদার হতে চান না। সে ধরেই নেয় আমার স্বামী আমাকে দেখবে। এই দেখাদেখিটা পারস্পরিক হওয়া উচিত। তাই নয় কি?”

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ সুজিত সরখেলও এ প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর কথায়: “এখন প্রত্যেক মহিলাই কিছু না-কিছু করেন। ক্রমাগত তাঁরাও কাজ করে চলেছেন। সংসারের স্বার্থে আর্থিক উপার্জনে তাঁরাও এগিয়ে আসছেন। ফলে নারী-পুরষ উভয়ই উপার্জন করছেন। সেখানে যদি তাঁরা কাজ ভাগাভাগি না করেন, তা হলে মুশকিল হবে খুবই। তিনটে বিষয় আছে এখানে।

প্রথমত, নারী শিক্ষা। নারী শিক্ষার দিকটা ভুললে চলবে না। যে মহিলা লেখাপড়া করেছেন, তিনি আগে থেকেই জানেন যে পরের ঘরে গিয়ে তিনি ঠিকে কাজ করবেন না। শখে করলেন, সেটা আলাদা কথা।

দ্বিতীয়ত, মহিলারাও অর্থনৈতিকভাবে পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। সুতরাং তাঁর উপর বাড়ির কাজ ঠেলে দিলে চলবে না।

তৃতীয়ত, এখন সবই নিউক্লিয়ার পরিবার। যৌথ/একান্নবর্তী পরিবারে ৩-৪ মহিলা মিলে হাতে-হাতে বাড়ির কাজ করতেন একটা সময়। ফলে পুরুষ-সদস্যরা রেহাই পেতেন। নিউক্লিয়ার পরিবারে কিন্তু সেটা চলে না। চলানো উচিতও না। দু’জনকেই মিলেমিশে কাজ করতে হবে। ফলে শহর এবং শহরতলিতে নারী-পুরুষের বিভেদের বিষয়টা অনেকটাই মিটে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। এটা একটা ভাল লক্ষণও বটে। তার উপর এখন আবার দেখাশোনা করে বিয়ে হয় না। প্রেম করেই হচ্ছে। ফলে শুরু থেকে পারস্পরিক বোঝাপড়াটাও হয়ে যাচ্ছে।”

সোহিনী সেনগুপ্ত এবং ডঃ সরখেল আগের প্রজন্মের কাছেও একটি বার্তা দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, বাড়ির বয়স্ক মা-জেঠিমা-দিদাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছনো দরকার যে, পুরুষের বাড়ির কাজ করার বিষয়টাও খুবই স্বাভাবিক। সেটা তাঁরা আশপাশে খোঁজ নিলেই দেখতে পারবেন। ফলে কালচার শক-এর জায়গা থেকে ধীরে-ধীরে তাঁদেরও সরে আসতে হবে। ডঃ সরখেল এ-ও বলেছেন, “দু’চার দিন যাক। হাউজ় ওয়াইফ বিষয়টাই একটি পুরোদস্তুর পেশায় পরিণত হবে। কিছুদিনের মধ্যেই দেখবেন আইন চালু হয়েছে, বাড়ির কাজ সামলানোর জন্য তাঁকে উপযুক্ত পারশ্রমিকও দিতে হবে।”

গ্র্যাফিক্স: অভিজিৎ বিশ্বাস

আরও পড়ুন: Women’s Day 2022: ‘গ্রুপিজ়ম’-এ নারীরা, শিখছে আর শেখাচ্ছে সাবলম্বী হওয়ার পাঠ

আরও পড়ুন: Women’s Day 2022: আমি পেশাগতভাবে ডিজে… মিউজিক বাজাই, বেলেল্লাপনা করি না