Narayan Debnath Demise: ৫০ বছর একা হাতে কাজ করেছেন নারায়ণ দেবনাথ, এটা একটা বিশ্ব রেকর্ড: কার্টুনিস্ট উদয় দেব
মঙ্গলবারের (১৮.০১.২০২২) সকালটা শুরুই হয়েছে হৃদয় নিংড়ে নেওয়া একটা খবরে। প্রয়াত 'বাঁটুল দ্যা গ্রেট', 'হাঁদা ভোঁদা', 'নন্ট ফন্টে'-এর জনক নারায়ণ দেবনাথ। তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন বহু অনুজ। তাঁদের মধ্যেই একজন কার্টুনিস্ট উদয় দেব। তিনি মানতেই পারছেন না প্রিয় 'জ্যেঠু' আর নেই। TV9 বাংলার জন্য কলম ধরে সেই কথাই ব্যক্ত করেছেন উদয়।
প্রথমেই একটা কথা বলতে চাই, নারায়ণ দেবনাথ যে নেই, এটা আমি বিশ্বাসই করি না। তিনি অমর। মানুষ ইম্মর্ট্যাল নয়, কিন্তু কিছু কিছু সৃষ্টি থাকে, যেটা চিরকালীন। তাঁদের কখনও মৃত্যু হয় না। নারায়ণ দেবনাথ তেমনই একজন মানুষ। ওঁকে জ্যেঠু বলে ডাকতাম। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একটাই কন্ডিশন ছিল, সব আড্ডা হবে, যদি আমি ফিশফ্রাই নিয়ে যাই। হাওড়ায় একটা ফিশফ্রাইয়ের দোকান আছে। সেই দোকানের ফিশফ্রাইয়ে যদি একটা কামড় না দেন, উনি আড্ডা দেবেন না বলেই দিয়েছিলেন।
উনি আজ চলে গিয়েছেন। দুঃখ তো সবসময়ই থাকে। প্যান্ডেমিকের সময় বার বার বলতেন আমাকে তো ভুলেই গেছ। আর আসই না। রোজই অপেক্ষা করছিলাম, কবে দেখা করব। কিন্তু অনেক বয়স হয়েছিল তো। ৯৭ কম কথা নয়। বয়সজনিত অনেক সমস্যাও ছিল। ভয় পেতাম। জানি না তো আমি ভাইরাসের ক্যারিয়ার কিনা। যদি সংক্রমিত করে দিই। তাই যেতাম না।
তবে নায়ারণ দেবনাথকে নিয়ে কথা বলতে হলে সবার প্রথমে আমি একটা কথা বলতে চাই। একটু আগে সেটা নিয়েই আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। পৃথিবীর যত কমিক্স আছে, যেমন ‘অ্যাস্টেরিক্স’, ‘টিনটিন’… এবং আরও যা যা আছে, এর নেপথ্যে বিরাট টিমওয়ার্ক কাজ করেছে। কিন্তু নারায়ণ দেবনাথ ছিলেন একা এবং একক। কেবল তাই নয়, ব্রাশের ব্রিসিল ক্ষয়ে গিয়েছে, দু’টাকা দামের পেপার, দামী রং নেই, বিদেশি কালার নেই, ফটোগ্রাফার নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কাজ থামাননি। ছোট্ট একটা জায়গা থেকেও যে দীর্ঘ ৫০ বছর কমিক্স করা যায়, প্রমাণ করেছিলেন। এটা একটা বেনজির ঘটনা। ৫০ বছর একা হাতে, সবদিক সামলে কাজ করে গিয়েছেন। কতজন পারবেন?
এটা কিন্তু একটা বিশ্ব রেকর্ডও। কিন্তু একটাই দুর্ভাগ্য, বাংলায় বসে উনি কাজ করেছেন এবং সমস্ত সৃষ্টিই যেহেতু বাংলা ভাষায়, বিশ্বের সব ক্ষেত্রে পৌঁছে দেওয়া যায়নি এখনও। এটাই যদি ইংরেজিতে উনি করতেন, আমি দাবি রাখছি, ১৬-১৮টি ভাষায় সারা পৃথিবীতে প্রচার হত। এর মধ্যেও আমি ধন্যবাদ জানাব শান্তনু ঘোষকে ও লাল মাটি প্রকাশনীকে। তাঁরা নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে ‘বাটুল দ্যা গ্রেট’ ও ‘নারায়ণ দেবনাথ সমগ্রহ’র চারটি ভলিউম বের করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওঁর পাশে ছিলেন। যাবতীয় শারীরিক অসুস্থতার সময় আর্থিক খরচ বহন করেছে।
আমি অনেক শিল্পী দেখেছি, আরও শিল্পী হয়তো দেখব। কিন্তু এরকম নির্লোভ শিল্পী, যে কেবল তাঁর সৃষ্টিটাই ভাবতেন, অর্থ নিয়ে ভাবতেন না, এরকম কিন্তু আমি দেখিনি। কলেজ স্ট্রিট বই পাড়া থেকে তিনি কী পেলেন কিংবা কী হারালেন, এটা নিয়ে ওঁকে কোনওদিনই বিচলিত হতে দেখিনি। কেবল নিজের কাজ করে গিয়েছেন। শিশুর মতো ছিল মনটা। একটা বিষয়ই মনের মধ্যে চলত, ‘আমি কী করছি এবার আগামী দিনে আমি কী করব’। এটা নিয়েই ভেবে গিয়েছিলেন আজীবন।
ওই ছোট্ট একটা জায়গায়, এ ফোর (A-4) সাইজ়ের পাতায় একাধিক লেখা এবং প্রত্যেক অক্ষরের মধ্যে সামঞ্জস্য দেখে বোঝায় উপায় নেই। মনে হবে যেন ছাপানো হয়েছে। এটা শেখার মতো বিষয়। গুরুর আসনে বসিয়ে সারাজীবন অনেককিছু শিখেছি। আমার মনে পড়ছে, যেই ওঁর কাছে যেতেন, ছোট-বড় নির্বিশেষে স্নেহভরে তাঁকেই একটি বাঁটুল এঁকে দিতেন। সময়, দর্শন, সমাজ নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন। ‘বাঁটুল’, ‘হাঁদা ভোঁদা’, ‘নন্টে ফন্টে’-এর মতো সৃষ্টি করে গিয়েছেন। চিরকালীন উপহার দিয়ে গিয়েছেন আমাদের। সাজিয়েছেন আমাদের শৈশবকে। আমরা তাঁকে কী ফেরত দিতে পারলাম… সেটাই ভাবি!
আরও পড়ুন: প্রয়াত হাঁদা-ভোঁদা-বাঁটুল স্রষ্টা ‘পদ্মশ্রী’ নারায়ণ দেবনাথ