Shantanu Maitra: ‘বাঘ জঙ্গলের সুপারস্টার’, শান্তনু মৈত্র’র বাঘের গান তৈরির নেপথ্য গল্প
Inside Story: শান্তনু মৈত্রের গানের লিরিকে বাঘের লেজ খুব মোটা, গোঁফ যেন চোরকাঁটা। থাবা দিয়ে খোখো খেলে সে। এখানেই সত্যজিতের বাঘের সঙ্গে শান্তনুর বাঘের পার্থক্য।

নন্দন পাল
“সো যা, নেহি তো গব্বর আ জায়েগা…”
রামগড়ের আশপাশের গাঁ-গঞ্জ। ইস্টম্যান কালারে, কোড্যাক ফিল্মে, জয়-বীরুর রণক্ষেত্র। ‘শোলে’র সেই রামগড়ের দৃশ্যপটের খুব একটা বদল হয়নি এই ওটিটি জেনারেশনের বাবা-মায়েদের। ব্যাকড্রপে যেন আজও বাজে গব্বরের আতঙ্ক। মা ‘লোরি’ না গেয়ে, ঘুমপাড়ানি গানের বদলে বলেন সেই অমোঘ ফিয়ার সাইকসিসের ডায়ালগ। ‘সো যা নেহি তো…’ আতঙ্কের বীজ ছোটদের কচি মনে রোপণ করলে ঘৃণা, দ্বেষ আর হিংসার মহীরুহ তৈরি হতে বাধ্য। তাই যখন আমরা অভিভাবক হলাম, মানে আমার মেয়ের বয়স যখন এক বছর (আমারও বাবা হিসাবে বয়স এক বছর, আমার তখন স্ত্রী এক বছরের মা) তখন থেকে একটা বিষয় ঠিক করলাম। ভয় দেখিয়ে কোনও কাজ মেয়েকে দিয়ে করাব না। ‘খেয়ে নাও নইলে ভূত আসবে’, ‘শুয়ে পড় নইলে বাঘে আসবে’… এসব একদম করব না। এসব ঠিক নয়—সাইকোলজিস্ট আর সাইকিয়াট্রিস্টরা বলেন, ছোটরা কল্পনাপ্রবণ। আপনি কাজ হাসিলের জন্য হয়তো বলছেন। ও কিন্তু ভিজ়ুয়ালাইজ করছে। মানে স্ক্রিপ্ট তৈরি করছে। দেখছে, ভুত,গব্বর অথবা এক আক্রমণকারী বাঘকে। ছোটবেলা থেকে আমারা শুনে এসেছি অনুপ ঘোষালের গাওয়া, সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ছবির গান ‘পায়ে পড়ি বাঘমামা’। সেই গানের একটি লাইন ‘যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা, কী হবে তা জানি বাবা, হারা যাবে তাজা ২টি প্রাণ তো’।

“কিন্তু বলুন তো সত্যি কি তাই? বাঘ নিয়ে এই ফিয়ার সাইকোসিস কেন? পৃথিবীর সবচেয়ে ডেঞ্জারাস স্পিসিজ তো মানুষ?” প্রতিবেদকের সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। ফোনের ওপারে কথাগুলো বলছিলেন যিনি, তিনি ইতিমধ্যে একটা নয়, আটখানা বাঘের গান বানিয়েছন। সত্যজিতের পর আবার বাঘের গান? হ্যাঁ, মশাই! আর সেই বাঙালি আর কেউ নন, তিনি সুরকার শান্তনু মৈত্র। TV9 বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয় শান্তনুর সঙ্গে। দু’-একবার মারাঠিতে ব্যস্ত ডায়াল টোনের পর ফোন যখন কানেক্টেড হল, তখন ‘ডানকি’র সঙ্গীত পরিচালক আগলহীন, অবিরাম কথা বলে চললেন।
“ভারতের জাতীয় পশু বাঘ সংরক্ষণের ৫০তম বছর এটা। বাঘের সংখ্যা খুব কমে গিয়েছিল। শেষ ১০-১৫ বছরে নাটকীয়ভাবে বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে। এটা আন্তর্জাতিক মহলে এখন একটা গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। কীভাবে এটা সম্ভব হল! সংরক্ষণ ততক্ষণ সাফল্য পাবে না যতক্ষণ বিজ্ঞানী, বনবিভাগ আর পরিবেশকর্মীরা সাধারণ মানুষকে পাশে পাবেন না। টাইগার উইল গ্রো দ্য ইকোনমি (বাঘ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে)। একটা উদাহরণ দিচ্ছি আপনাকে। তাডোবা টাইগার রিজার্ভে আগে একটা গেট ছিল। ওখানকার বনাধিকারিকরা ঠিক করেন ওখানে ১৭টা গেট হবে। মোর গেট মিনস মোর ইকোনমি (বেশি গেট মানে শক্তিশালী অর্থনীতি)। আশ্চর্যের বিষয় ওই গেটগুলি তৈরির টাকা দেয়নি সরকার, কোনও বেসরকারি সংস্থাও নয়। কে দিয়েছে জানেন? বাঘ। হ্যাঁ বাঘ দেখতে লোকজন আসছেন, আর সেই রেভিনিউটা এখনে ফান্ডিংয়ের কাজ করে পরিকাঠামো তৈরি করে দিল। ভাবুন একবার এই মডেলটা।”

WWF-এর হিউম্যান অ্যান্ড এনিম্যাল কো-এগজিস্ট্যান্স অ্যাম্বাসাডর শান্তনু মৈত্র তখন আর শুধুই মুম্বই বা টলিউডের ব্যস্ত সুরকার নন, একজন দরদি কনজারভেশনিস্ট। তিনি ভেবেছিলেন, গানের মাধ্যমে বাঘ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করবেন। তাঁর আক্ষেপ ছিল: ছোটদের সংরক্ষণের কাজে নেওয়া হয় না। ওরা যেন এই বৃত্তের বাইরে। তাই এই গানে ছোটরাই বড় ভূমিকায়। ফোনে শান্তনু বলছিলেন, “আমি তো গান ছাড়া কিছু করতে পারি না। তাই-ই ভাবছিলাম বাঘ সংরক্ষণের জন্য গান তৈরি করলে কেমন হয়। সুব্বাইয়া নাল্লামুত্থু প্রসিদ্ধ ওয়াইল্ডলাইফ সিনেমাটোগ্রাফার। ওঁর ফুটেজ বারবার দেখি। তারপর কথা লিখলেন তানভীর গাজি। তৈরি হল গান। ‘তান্দানা তান্দানা’ টাইগার অ্যান্থেম। হিন্দি, রাজস্থানি, বাংলা সহ-৮টি ভারতীয় ভাষায় হয়েছে এই গান। আসলে কি বলুন তো, বাঘ জঙ্গলের সুপারস্টার। তাকে দেখতে এসেই অনেক কিছু, প্রায় সব দেখা হয়ে যায় জঙ্গলের।” আপনারা যদি ইন্টারনেটে সার্চ করেন দেখেন, টাইগার অ্যান্থেমের বাংলা সংস্করণে বাঘের ছানা বলছে: “তান্দানা তানানা কত মজার দুনিয়া আমাদের এই দুনিয়া এই হাওয়া গাইছে গান পাখিদের কলতান।
নরম রোদ হাসছে আজ জলে নেমে কাটছি সাঁতার গাছেরা দুলছে, মেঘেরা খেলছে ময়ূর কেন নাচে রে?
কাঠবেড়ালি ঘুরছে খালি কে দানা খেয়ে গেল রে?
এই জঙ্গল আর আমাদের পাহাড়, এসব এমনই থাকবে তো মা? এই যে রঙিন সোনালি দিন এসব এমনই থাকবে তো মা?”
শান্তনু মৈত্রের গানের লিরিকে বাঘের লেজ খুব মোটা, গোঁফ যেন চোরকাঁটা। থাবা দিয়ে খোখো খেলে সে। এখানেই সত্যজিতের বাঘের সঙ্গে শান্তনুর বাঘের পার্থক্য। এই বাঘ যেন আমার-আপনার ঘরের খুদে সদস্যটি। ছুটছে, খেলছে, খুনসুটি করছে, লেজ ধরে ঝুলছে, পড়ে যাচ্ছে এবং আবার পরমুহূ্র্তেই উঠে দাঁড়াচ্ছে। যে পুঁচকের জন্য আপনার দিনরাত ভাবনা। যার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই, বাবা মায়েদের। যার জন্য কত ফিউচার প্ল্যানিং!

অথচ জঙ্গলের রাজ্যে, বাঘেদের সংসারের নিয়মে? দেড় বছর হলেই ছেড়ে যেতে হবে মাকে! এক অনন্ত, অচেনা দুনিয়ায়। যেখানে পদে-পদে বিপদ! বাঘেদের বাবারা যত্নশীল তো নয়ই, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী। তার ওপর, মানুষের বন দখল আর চোরাশিকার বাড়তি দুশ্চিন্তা। কে বাঁচাবে দেড় বছরের বাঘের বাচ্চাটিকে? বাঁচাতে হবে মানুষকেই। আগামী প্রজন্মদেরই। তাই ছোটদের দিয়ে শান্তনু মৈত্র গাওয়ালেন এই গান। পয়েন্ট অফ ভিউ, ছোট্ট এক শার্দূল শাবকের। আর ওই ফিয়ার সাইকোসিস? নেই স্যার, নেই ম্যাডাম! মনটা ফুরফুরে হয়ে যাবে। বাঘ যে কতটা সুন্দর, কতটা মজার… ওদের শৈশবও ঠিক যেন আমাদের মত। ঠিক যেন উইলিয়াম ব্লেকের কবিতার পাশেই বসে শান্তনু মৈত্রের গান, ‘তান্দানা তানানা তান্দানা তানানা।’
