প্রেম বলতে যে সব তুলতুলে, পেলব চিন্তা আমাদের চোখের পাতায় সারাদিন বসে থাকে, কখনও বা আমাদের গভীর রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখে, তা নিয়ে কাব্য-কবিতায় প্রায় সবই লেখা হয়ে গিয়েছে। তবে বাস্তব জীবনে প্রেমে থাকা ঠিক কতটা নরম, কতটা নিরাপদ তাই নিয়ে ধাঁধা থেকেই যায়। যাঁরা প্রেমে আছেন বা থাকেন, সেই প্রেমকে পৃথিবীর সামনে যাঁরা আরামে প্রকাশ করতে পারেন, তাঁদের কাছে হয়তো ৩৬৫ দিনই ভালবাসার দিন। তাঁদের জন্য চিন্তা নেই।
আমার কাছে প্রেমদিবসের গুরুত্ব অনেকটাই বৃহত্তর সামাজিক চেতনাগুলো নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করার প্রয়োজনীয়তায়। প্রেম-ভালবাসা-সম্পর্ক-যৌনতা, এই সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি আছে, সমাজ আছে, রাষ্ট্র আছে, ধর্ম আছে, পুঁজিবাদ আছে। এই মিলিত ক্ষমতা এক ধরনের ভালবাসাকে সিংহাসনে বসিয়ে বাকি সবটাকেই মার্জিনে ঠেলে দেয়। সেখানেই প্রেমের পরাজয়।
ঠিক যেমন নারীদিবসে… আমরা সমাজে নারীর অবস্থা ও অধিকার নিয়ে কথা বলি, তেমনভাবেই যদি প্রেমদিবস উদযাপন করতেই হয়, প্রেমের অধিকার নিয়ে কথা হোক!
প্রেম যে কেবলমাত্র পুরুষ-নারীর মধ্যেই ঘটতে থাকা এক মধুর রাসায়নিক প্রক্রিয়া, আগে সেই চিন্তার উপর বুলডোজ়ার চালাতে হবে। এই ধরুন, বাড়ির ছেলের ষোলো বছর বয়স হলে তাকে যদি ভ্যালেন্টাইনস ডে-র দিনে গার্লফ্রেন্ড খুঁজতে বলি, তাহলে সে মুখ ফুটে বলবে কী করে? যে সে মেয়েদের নিয়ে ভাবছেই না! আসলে সে তার সহপাঠী একটি ছেলেকে খুব ভালবাসে? তাকে সঙ্গে নিয়ে, তার হাত ধরেই কাটাতে চায় দিনটা। খুব স্বাভাবিক, খুব মানবিক, খুব জৈবিক একটি প্রবৃত্তিকে প্রকাশ করার জায়গা না দেওয়াটা আমাদের অক্ষমতা। অথচ তা না করে আমরা তার মনে অপরাধবোধের বীজ বপন করি। তার প্রেম, তার চাহিদা, তার অস্তিত্বকে সঙ্কটে ফেলে দিয়ে কীসের প্রেমদিবস উৎযাপন?
এইভাবেই আরও নানা পাথরের ভারে চাপা পড়ে মরে প্রেম। ‘উঁচু জাতের’ সঙ্গে ‘নীচু জাতের’ প্রেম হলে আজও দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়েকে ভালবাসলে তাকে ‘লাভ জেহাদি’ তকমা দিয়ে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা আমরা করি। দুই ষাটোর্ধ্ব মানুষ একে অন্যের প্রেমে পড়লে বলি, ছিঃ ছিঃ, এই বয়সে আবার ওসব কী?
প্রেমের কথা ভাবতে গেলেই যদি শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স, লিঙ্গের কচকচি শুরু হয়, তাহলে সেই প্রেম অনুভূতির সৌন্দর্য্য নয়, সেই প্রেম একটি সামাজিক ব্যবস্থা। সমাজে থাকা বিভাজনগুলোকে আর একটু পোক্ত করে তোলার আয়োজনের বেশি আর কিছুই নয়। সেই ঘেরাটোপের ভিতরে থেকে যত খুশি প্রেম করুন, রাষ্ট্রকে খুশি রাখুন। বাকিটুকু নাটক-নভেলের জন্য তোলা থাক, ওসব বাস্তব জীবনে চলে না।
জানতে চাই, আমাদের প্রেম-ভালবাসার অনুভূতিগুলোর মধ্যে কোথাও কি প্রচ্ছন্ন অপরাধবোধ কাজ করে? যদি তাই হয়, তা হলে প্রেম দিবসের কাজ প্রেমের পক্ষে যুদ্ধ করার, সবরকমের সম্পর্ককে মান্যতা দেওয়ার লড়াই করার। অনেক হল, এবার একটু চিরাচরিত সমাজ-নির্দিষ্ট প্রেমের ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করি আমরা? আসুন, ভালবাসার দিনে ভালবাসাকে আরামে নিঃশ্বাস নিতে দিই…
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ
আরও পড়ুন: Valentine’s Day: ‘বিরহ শব্দের অর্থ বিশেষভাবে রহ… আমি তোমারও বিরহে রহিব বিলীন…’
আরও পড়ুন: Valentine’s Day: ‘যে কোনও জন্তুকেই মানুষের থেকে বেশি বিশ্বাস করি’, বলছেন প্রাক্তন আরজে অয়ন্তিকা
আরও পড়ুন: Valentine’s Day Special: ‘লাভ মি থোড়া অউর’… ইশকওয়ালা LOVE এবং AAJ KAAL-এর ভাষা
আরও পড়ুন: Valentine’s Day: টিন্ডার-প্রেম… App মুঝে অচ্ছে লগনে লগে