ভগ্ন দশা হলেও শিল্পীদের পাশে উত্তমকুমারের ‘শিল্পী সংসদ’

"মহানায়ক কখনও চাননি কারও কাছে হাত পাততে। সেই আদর্শেই আমরা এগিয়ে চলেছি,’’ বললেন ‘শিল্পী সংসদ-এ’র পাঁচ দশকের সেক্রেটারি সাধনবাবু।

ভগ্ন দশা হলেও শিল্পীদের পাশে উত্তমকুমারের ‘শিল্পী সংসদ’
উত্তমকুমারের তৈরি শিল্পী সাংসদ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 03, 2021 | 6:59 PM

প্রীতম দে: মৌলালি লাগোয়া ধর্মতলা। ফুটপাথের ধারে লোহা-লক্কর ঝালাইয়ের দোকান। লাল ছোট গির্জার ঠিক উল্টো দিকে আদ্দিকালের দুধ বের-করা আগাছা ভর্তি দু’টো স্তম্ভের মাঝখানে পুরনো দিনের সাইনবোর্ড। উত্তম কুমারের হাতে স্থাপিত শিল্পীদের একমাত্র সংগঠন ‘শিল্পী সংসদ’। ডান দিকের থামের গায়ের উপর চটে যাওয়া শ্বেতপাথরে কালো হরফে লেখা ‘শিল্পী সংসদ’। অতি উত্তম।

লোহা-লক্কর পেরিয়ে মূল দরজার কাছে গেলেই চিঠি ফেলার ডাকবাক্স। তার উপর লেখা ‘শিল্পী সংসদ’। কালিঝুলি মাখা ভগ্নপথ যেন ভুতুড়ে বাড়ির অন্দরমহল। কে জানে এই পথের শেষে দেখা মিলবে ‘ভুবন ভুলানো হাসি’। পুরনো আসবাব। ভাঙাচোরা কড়িবর্গা আর বড়-বড় প্রমাণ সাইজের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি। উত্তমবাবুর তৈলচিত্র, পোর্ট্রেট। বিকাশ রায়, জহর রায়, সুপ্রিয়া দেবী, সুচিত্রা সেন… আরও কত অধুনা নাম-না-জানা সেই দিনের পরিচিত জন।

পাশের চেয়ারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে উঁচু শৃঙ্গের কালিঝুলি মাখা অ্যান্টিক ঘরে উপস্থিত একমাত্র ব্যক্তি বলবেন, ‘‘মহানায়ক ওই চেয়ারটাতেই বসতেন।’’ ‘দাদা’ উত্তমকুমারের এক সময়ের ছায়াসঙ্গী সাধন বাগচী ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘শিল্পী সংসদ’ সামলে আসছেন। চুলে কলপ, হাতে অ্যাটাচি। আর মুখে হাসি। এটাই তাঁর পরিচয়। সাধনের কথায়, ‘‘৬০’-এর দশকে যখন ‘দাদা’ মানে মহানায়ক ঠিক করলেন শিল্পীদের জন্য সংগঠন করবেন, তখন থেকেই ময়রা স্ট্রিট-এর বাড়ি থেকে ধর্মতলা স্ট্রিটের এই বাড়ির মধ্যে সেতুবন্ধন হয়ে গেল। প্রথম দিকে সেরকম ফান্ড উঠছিল না। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন একটা ছবি করতে হবে: ‘বনপলাশীর পদাবলী’। কলাকুশলী সবাই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন এবং উত্তমকুমার পরিচালনা থেকে অভিনয়—সবটাই ফ্রিতে।’’

দুস্থ শিল্পীদের জন্য উত্তমকুমার ফিক্সড করে দিলেন উপার্জিত টাকা। ‘‘তুলসী চক্রবর্তীর স্ত্রী থেকে শুরু করে ঋত্বিক ঘটক… নাম শুনলে চমকে উঠতে হয়। এঁদের সবাইকে ‘শিল্পী সংসদ’-এর তরফ থেকে প্রতি মাসে সাহায্য করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত নয়-নয় করে এক কোটি সহায়তা মূল্য বলতে পারেন,’’ বলছেন সাধনবাবু। তাঁর সংযোজন, ‘‘উত্তমকুমার ‘মহানায়ক’ হয়েও কত সাদাসিধে পরোপকারী মানুষ ছিলেন, তা আমার চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না।’’ একবার দুস্থ শিল্পীদের সাহায্যের জন্য রাবীন্দ্রিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন ‘মহানায়ক’। দেবব্রত বিশ্বাস কে গান গাওয়াতে হবে। ‘দাদা’ বললেন: ট্যাক্সি ডাকো। স্মৃতির সরণিতে পদচারণা করতে-করতে বলছেন সাধনবাবু, ‘‘ভাবুন একবার… দেরি হয়ে যাবে বলে উত্তমকুমার ট্যাক্সি করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। কারণটা কী? দেবব্রত বিশ্বাস এলে বেশি টিকিট বিক্রি হবে। ফলে দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে জানানোর জন্য বেশি ফান্ড জোগাড় করা যাবে।’’ প্যান্ট-শার্ট পরিহিত ‘মহানায়ক’কে চিনতে পারেনি দেবব্রত বিশ্বাস। ঘরের চৌকাঠে মোড়ার উপর বসে রয়েছেন উত্তমকুমার। অনুরোধ করলেন অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। জর্জ বিশ্বাস মুখের উপর বলে দিলেন, ‘‘গান গাইতে পারুম না।’’ পরে বুঝতে পেরে রাজি হন।

দরজার কাঠ ঘুন ধরা। কাগজ, পুরনো অ্যালবাম উইয়ে খাওয়া। কিন্তু এখনও জনা তিরিশেক দুস্থ শিল্পী প্রতিমাসে আর্থিক সাহায্য পান। “মহানায়ক কখনও চাননি কারও কাছে হাত পাততে। সেই আদর্শেই আমরা এগিয়ে চলেছি,’’ বললেন ‘শিল্পী সংসদ-এ’র পাঁচ দশকের সেক্রেটারি সাধনবাবু।